পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

& So রবীন্দ্ররচনাবলী পর্যন্তই অনুরাগ দেখায়, জরাজর্জর হইলে কেহ একটি কথাও জিজ্ঞাসা করে না। মানবহৃদয়ে যে অকৃত্রিম মৃত্যুঞ্জয় প্রেম আছে, সে প্রেমের ছবি তাহারা গোপন করিয়া যান। তাহারা বলেন সংসারো ভাতি রমণীয়ঃ।” অর্থাৎ, যে-সকল চারুতা দ্বারা সংসারকে রমণীয় বোধ হয়, সে-সকল চারুতা বিচারের চক্ষে তিরোহিত হইয়া যায়। , এই সকল লয়তত্ত্ববাদীরা জগতের মধ্য দিয়া আত্মসম্প্রসারণ করিতে চাহেন নাই বলিয়াই, জগৎ হইতে জগৎবাসীকে প্রতিনিবৃত্ত করিতে চাহিয়াছিলেন বলিয়াই, জগতের প্রতি বারংবার এত কলঙ্ক আরোপ করিয়াছেন। মানবের অকৃত্রিম প্রেমের মধ্যে, বিশ্বজগতের চিরনূতন চারুতার মধ্যে জগদীশ্বরের প্রেম এবং ঐশ্বৰ্য নির্দেশ করা তাহদের তত্ত্বের বিরুদ্ধ। কারণ, তাঁহাদের ঈশ্বর নিগুণ, তাহদের জগৎ মায়া। কিন্তু বৈষ্ণবেরা জগতের সৌন্দর্যকে সুন্দর বর্ণে চিত্ৰিত করিতে ভীত হন নাই এবং তাহারা বলেন, ঈশ্বরকে প্রেমস্বরূপ বলেন। বিশ্বের সমস্ত সৌন্দর্য তাহার বংশীধ্বনি, তাহার প্ৰেমসংগীত, আমাদের প্রতি র্তাহার আহবান। ভক্ত এবং ঈশ্বর যদি স্বতন্ত্র না থাকেন, তবে এ সৌন্দৰ্য কিসের সৌন্দর্য, কাহার কাছে সৌন্দৰ্য চন্দ্রনাথবাবু যে “বিশ্বব্যাপী বিশ্বরূপ সৌন্দর্যের’ কথা বলিয়াছেন, লয়তত্ত্বে সে সৌন্দর্যের স্থান কোথায়? কারণ, ভেদজ্ঞানমাত্রেই মায়া- ভেদজ্ঞান ব্যতীত সৌন্দর্যের কোনো অস্তিত্বই থাকিতে পারে না, যেহেতু সৌন্দৰ্য অনুভবসাপেক্ষ। ঈশ্বরকে যতক্ষণ সুন্দর বলিব, ততক্ষণ ভক্তকে তাঁহা হইতে স্বতন্ত্র স্বীকার করা বৈ আর গতি নাই। এইজন্য চন্দ্রনাথবাবু ব্যতীত কোনো লয়তত্ত্ববাদী ব্ৰহ্মাকে সুন্দর বলেন না। তাহারা বলেন অনৰ্থস্থলহম্বমদীৰ্ঘমজমব্যয়ং। ৫ অরূপগুণবর্ণখ্যং তদব্ৰহ্মেত্যবধারয়োৎ। r যাহা হউক, চন্দ্ৰনাথবাবু যাহাকে বিরাট লয়’ বলেন, তাহা লয় নহে আত্মসম্প্রসারণ, অর্থা লয়ের ঠিক বিপরীত। তাহার মতে নিগুণ ব্ৰহ্মা নিগুণ নহেন, প্রকৃতপক্ষে সগুণ এবং এই জগৎ তাহার সৃষ্টি, তাহার লীলা। অসৎ জগৎ প্রকৃতপক্ষে অসৎ নহে এবং বহু সাধনার পর চরম জ্ঞান লাভ করিলে একটা বিশ্বব্যাপী বিশ্বরূপ সৌন্দৰ্য দেখিতে পাওয়া যায়। এরূপ লয়তত্ত্ব যে আমাদের মতের বিরুদ্ধ নহে, তাহা আমাদের প্রতিবাদ পড়িলেই পাঠকেরা বুঝিতে পরিবেন। কারণ, আত্ম হইতে পার এবং পর হইতে পরমাত্মার প্রতি আত্মার প্রসারণএবং জগৎ হইতে জগদীশ্বরের অসীম সৌন্দর্যের উপলব্ধি, বোধ করি, জগতের সমুদায় শ্রেষ্ঠ ধর্মমতেরই লক্ষ্য। ঈশ্বরের প্রতি একান্ত আত্মসমৰ্পণ করিয়া স্বার্থপরতার বিনাশ সাধন, বোধ করি, খৃস্টানধর্মেরও উপদেশ। ঈশ্বরচরিত্রকে আদর্শ করিয়া আপন ক্ষুদ্রতা পরিহার করা খৃস্টীয় ধর্মশান্ত্রের একটি প্রধান অনুশাসন এবং সকল উন্নত ধর্মশান্ত্রেই সেই উপদেশ দেয়। চন্দ্রনাথবাবু যদি ইহাকে লয়তত্ত্ব নাম দেন। তবে তাহার ভাষা সম্বন্ধে আমরা আপত্তি করিব, বলিব- লয়কে লয় অর্থে ব্যবহার না করিয়া তাহার বিপরীত অর্থে ব্যবহার করিলে কোনো ফল নাই, বরঞ্চ বিপরীত ফলেরই সম্ভাবনা; অতএব যখন তিনি “আত্মসম্প্রসারণ’-নামক একটি শব্দ রচনা করিয়াছেন এবং উক্ত শব্দে তাহার মনোভাব যথাৰ্থ ব্যক্ত হইতেছে, তখন ওই শব্দটাকেই যথাস্থানে প্রয়োগ করিলে সাধনা'র সমালোচক এবং ‘সাহিত্যের পাঠকগণকে কোনোরাপ বিভ্রাটে ফেলা হইবে না। : ETA » Raa