পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমাজ । Oay পাওয়া যায় না। যাহার যথাৰ্থ বল আছে সে সর্বদাই ভদ্ৰ- সে তাহার বলটাকে গণ্ডায়ের শিঙের মতো অহােরাত্র নাকের উপর খাড়া করিয়া রাখে না। আর যে দুর্বল, হয় সে লাঙ্গুল গুটিাইয়া কুঁকড়ি মারিয়া থাকে, নয় সে খোঁকি কুকুরের মতো ভদ্রলোক দেখিলেই দূর হইতে অবিরত ঘেউ ঘেউ করিতে থাকে। আমরাও কেবল দূর হইতে অভদ্রভাবে ঘেউ ঘেউ করিতেছি। শব্দে কান প্ৰাণের সঙ্গে যখন কোনো কথা বলি, তখন যাহা বলি তাহারই একটা বল থাকে- যখন প্ৰাণে বাজে নাই। অথচ মুখে বলিতে হইবে, তখন চেচাইয়া বলিতে হয়, বিস্তর বলিতে হয়। বঙ্গ সমাজে যে আজকাল বিশেষ চোঁচামেচি পড়িয়া গিয়াছে ইহাও তাহার একটি কারণ। বক্তা। যখন বক্তৃতা দিতে উঠেন, তখন সে এক অতি কষ্টকর দৃশ্য উপস্থিত হয়। গ্ৰহণী রোগীর ন্যায় আঁহার হাতে পায়ে আক্ষেপ ধরিতে থাকে, গলার শির ফুলিয়া ওঠে, চোখ দুটা বাহির হইয়া আসিতে চায়। যিনি বাংলা দেশের কিছুই জানেন না, তিনি কথায় কথায় বলেন, ‘কুমারিকা হইতে হিমালয় ও সিন্ধুনদী হইতে ব্ৰহ্মপুত্র;" ফু দিয়া দিয়া কথাগুলাকে যত বড়ো করা সম্ভব তাহা করা হয়; যেখানে বাংলা দেশ বলিলেই যথেষ্ট হয়। সেখানে তিনি এশিয়া না বলিয়া থাকিতে পারেন না; যেখানে সামান্য জমা-খরচের কথা হইতেছে, সেখানে ভাস্করাচার্য ও লীলাবতীর উল্লেখ না। করিলে তাহার মনঃপূত হয় না; একজন ফিরিঙ্গি বালকের সহিত দেশীয় বালককে ঝগড়া করিতে দেখিলে তাহার। ভীষ্ম দ্ৰোণ ভীমাৰ্জ্জুনকে পর্যন্ত মনে পড়ে। যথার্থ প্ৰাণের সঙ্গে বলিলে কথাগুলা খাটাে খাটাে হয় ও কিছুই অতিরিক্ত হইতে পারে না। আজকালকার সাহিত্য দেখো-না কেন, এইরূপ চিৎকারে প্রতিধ্বনিত। পরিপূর্ণতার মধ্য হইতে যে একটা গভীর আওয়াজ বাহির হয়, সে আওয়াজ ইহাতে পাওয়া যায় না। যাহা-কিছু বলিতে হইবে তাঁহাই অধিক করিয়া বলা, যে-কোনো অনুভব ব্যক্ত করিতে হইবে, তাহাকেই একেবারে নিংড়াইয়া তিক্ত করিয়া তোলা। যদি আহুদি ব্যক্ত করিতে হইল, অমনি আরম্ভ হইল, বাজ বাঁশি, বাজ কঁশি, বাজ ঢাক, বাজ ঢোল, বাজ টেকি, বাজ কুলো- ইহাকে তো আনন্দ বলে না,ইহা এক প্রকার প্রাণপণ মত্ততার ভান, এক প্রকার বিকার রোগ; যদি দুঃখ ব্যক্ত করিতে হইল, অমনি ছুরি ছোরা, দড়ি কলসী, বিষ আগুন, হাঁসফাস, ধড়ফড়, ছটফট- সে এক বিপর্যয় ব্যাপার উপস্থিত হয়। এখনকার কবিরা যেন হৃদয়ের অন্তঃপুরবাসী অনুভাবগুলিকে বিকৃতকার করিয়া তুলিয়া হাটের মধ্যে দিগবাজি খেলাইতে ভালোবাসেন। কোনো কোনো কবিসমাজের নাসিকাকে উপেক্ষা করিয়া হৃদয়ের ক্ষতিগ্ৰস্ত ভাবকে হয়তো কোনো কুলবধূর নামের সহিত । মিশ্ৰিত করিয়া নিতান্ত বেআব্রু কবিতা লিখিয়া থাকেন। ইহাকেই চেচাইয়া কবিতা লেখা বলে। আমাদের প্রাচ্য-হৃদয়ে একটি আব্রুর ভাব আছে। আমরা কেবল দর্শকদের নেত্রসুখের জন্য হৃদয়কে উলঙ্গ করিয়া হাটে-ঘাটে প্রদর্শনের জন্য রাখিতে পারি না। আমরা যদি কৃত্রিম উপায়ে আমাদের প্রাচ্য ভাবকে গলা টিপিয়া না মারিয়া ফেলিতাম, তবে উপরোক্ত শ্রেণীর কবিতা পড়িয়া ঘূণায় আমাদের গা শিহরিয়া উঠিত। সহজ সুস্থ অকপট হৃদয় হইতে এক প্রকার পরিষ্কার । অনর্গল অনতিমাত্ৰ ভাব ও ভাষা বাহির হয়, তাহাতে অতিরিক্ত ও বিকৃত কিছু থাকে না-টানাহেঁচড়া করিতে গেলেই আমাদের ভাব ও ভাষা স্থিতিস্থাপক পদার্থের মতো অতিশয় দীর্ঘ হইতে থাকে ও বিকৃতাকার ধারণ করে। - যখন বাংলা দেশে নূতন ইংরাজি শিক্ষার আরম্ভ হইল, তখন নূতন শিক্ষিত যুবারা জোর করিয়া মদ খাইতেন, গোমাংস খাইতেন। চোচাইয়া সমাজ-বিরুদ্ধ কাজ করিতে বিশেষ আনন্দ বোধ করিতেন। এখনও সেই শ্রেণীর একদল লোক আছেন। তাহদের অনেকে সমাজ-সংস্কারক বলিয়া গণ্য। কিন্তু ইহা জামা আবশ্যক যে, তাহারা যে হািদয়ের বিশ্বাসের বেগে চিরন্তন প্রথার স্ত্রীলোকদের দুর্দশায় তাহদের যে কষ্টবোধ হয় তাহা নহে, তাহারা ষে হৃদয়ের মধ্যে অনুভব