পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8S 8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী সত্যের দুই দিক আছে- প্ৰথম, সত্য যে সে আপনা-আপনিই সত্য, দ্বিতীয়, সত্য আমার কাছে সত্য। যতক্ষণ-না। আমি সর্বতোভাবে অনুভব করি ততক্ষণ সত্য হাজার সত্য হইলেও আমার নিকটে মিথ্যা। সুতরাং আমি যখন অনুভব না করিয়া সত্য কথা বলি, তখন সত্যকে প্রায় মিথ্যা করিয়া তুলি। অতএব বরঞ্চ মিথ্যা বলা ভালো। তবু সত্যকে হত্যা করা ভালো নয়। কিন্তু প্রত্যহই যে সেই সত্যের প্রতি মিথ্যাচারণ করা হইতেছে। যাহারা বোঝে না। তাহারাও বুঝাইতে আসিয়াছে, যাহারা ভাবে না। তাহারাও টিয়া পাখির মতো কথা কয়, যাহারা অনুভব করে না তাহারাও তাহদের রসনার শুষ্ককাষ্ঠ লইয়া লাঠি খেলাইতে আসে। ইহার কি কোনো প্ৰায়শ্চিত্ত নাই! অপমানিত সত্য কি তাহার অপমানের প্রতিশোধ লইবেন না! লক্ষ লক্ষ বৎসর অবিশ্রাম ভান করিলেও কি কোনোকালে যথার্থ হইয়া ওঠা যায়! দেবতাকে দিনরাত্রি মুখ ভেংচাইয়াই কি দেবতা হওয়া যায়, না তাহাতে পুণ্য সঞ্চয় হয়! সম্পূর্ণ বিদেশীয় ভাবের সংস্রবে। আসিয়াই, বোধ করি, আমাদের এই উৎপাত ঘটিয়াছে। আমরা অনেক তত্ত্ব তাহাদের কেতাব হইতে পড়িয়া পাইয়াছি।-ইহাকেই বলে পড়ে পাওয়াঅর্থাৎ ব্যবহারী জিনিস পাইলাম বটে কিন্তু তাহার ব্যবহার জানি না। যাহা শুনিলাম মাত্র, ভান করি। যেন তাহাই জানিলাম। পরের জিনিস লইয়া নিজস্ব স্বরূপে আড়ম্বর করি। কথায় কথায় বলি, উনবিংশ শতাব্দী, ওটা যেন নিতান্ত আমাদেরই। একে বলি ইনি আমাদের বাংলার বাইরন, ওঁকে বলি উনি আমাদের বাংলার গ্যারিবলডি, তাকে বলি তিনি আমাদের বাংলার ডিমস্থিনিসঅবিশ্রাম তুলনা করিতে ইচ্ছা যায়- ভয় পাছে এটুকুমাত্র অনৈক্য হয়— হেমচন্দ্ৰ যে হেমচন্দ্ৰই এবং বাইরন যে বাইরনই, তাহা মনে করিলে মন কিছুতেই সুস্থ হয় না। জবরদস্তি করিয়া কোনোমতে বটকে ওক বলিতেই হইবে, পাছে ইংলন্ডের সহিত বাংলার কোনো বিষয়ে এক চুল তফাত হয়। এমনতরো মনের ভাব হইলে ভান করিতেই হয়- পাউডার মাখিয়া সাদা হইতেই হয়, গলা বঁকাইয়া কথা কহিতেই হয় ও বিলাতকে ‘হােম বলিতে হয়! সহজ উপায়ে না বাড়িয়া আর-একজনের কাধের উপরে দাঁড়াইয়া লম্বা হইয়া উঠিবার এইরূপ বিস্তর অসুবিধা দেখিতেছি! আমরা খলসেরা দেখিতেছি অ্যাংবাংগণ খুব থপথপ করিয়া চলিতেছে, সুতরাং খলসে বলিতেছেন, আমিও যাই! যাও তাঁহাতে তো দুঃখ নাই, কিন্তু আমাদের চাল যে স্বতন্ত্ৰ! আমাদের এ সাহিত্য প্ৰতিধ্বনির রাজ্য হইয়া উঠিতেছে। চারি দিকে একটা আওয়াজ ভো ভেঁা করিতেছে মাত্র, কিন্তু তাহা মানুষের কণ্ঠস্বর নহে, হৃদয়ের কথা নহে, ভাবের ভাষা নহে। কানে তালা লাগিলে যেমন একপ্রকার শব্দ শুনিতে পাওয়া যায়— সে শব্দটা ঘূৰ্ণবায়ুর মতো বনবনা করিয়া ঘুরিতে ঘুরিতে মস্তিষ্কের সমস্ত ভাবগুলিকে ধূলি ও খড়কুটার মতো আসমানে উড়াইয়া দিয়া মাথার খুলিটার মধ্যে শাঁখ বাজাইতে থাকে; জগতের যথার্থ শব্দগুলি একেবারে চুপ করিয়া যায় ও সেই মিথ্যা শব্দটাই সর্বেসর্বা হইয়া বৃত্ৰাসুরের মতো সংগীতের স্বৰ্গরাজ্যে একাধিপত্য করিতে থাকে; মাথা কঁাদিয়া বলে, ইহা অপেক্ষা অরাজকতা ভালো, ইহা অপেক্ষা বধিরতা ভালো- আমাদের সাহিত্য তেমনি করিয়া কঁদিয়া বলিতেছে- শব্দ খুবই হইতেছে কিন্তু এ ভো ভো, এ মাথাঘোরা আর সহ্য হয় না! এই দিগন্ত-বিস্তৃত কোলাহলের মহামরুর মধ্যে, এই বধিরকর শব্দ রাজ্যের মহানীরবতার মধ্যে একটা পরিচিত কণ্ঠের একটা কথা যদি শুনিতে পাই, তবে আবার আশ্বাস পাওয়া যায়- মনে হয়, পৃথিবীতেই আছি বটে, আকারআয়তনাহীন নিতান্ত রসাতলরাজ্যে প্রবেশ করিতেছি না। আমরা বিশ্বামিত্রের মতো গায়ের জোরে একটা মিথ্যাজগৎ নির্মাণ করিতে চাহিতেছিকিন্তু ছাঁচে ঢালিয়া, কুমারের চাকে ফেলিয়া, মস্ত একতাল। কাদা লইয়া জগৎ গড়া যায় না! বিশ্বামিত্রের জগৎ ও বিশ্বকর্মর জগৎ দুই স্বতন্ত্র পদার্থ- বিশ্বকর্মর জগৎ এক অচল অটল