পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Tref 8S 62 নিয়মের মধ্য হইতে উদ্ভিন্ন হইয়া বিকশিত হইয়া উঠিয়াছে, তাহার। আর বিনাশ নাই; তাহা রেষারেষি করিয়া, তর্জমা করিয়া, গায়ের জোরে বা খামখেয়াল হইতে উৎপন্ন হয় নাই; এই নিমিত্তই তাহার ভিত্তি অচলপ্রতিষ্ঠ। এই নিমিত্তই এই জগৎকে আমার এত বিশ্বাস করি।- এই নিমিত্তই এক পা বাড়াইয়া আর-এক পা তুলিবার সময় মাথায় হাত দিয়া ভাবিতে হয় না পাছে জগৎটা পায়ের কাছ হইতে হুস করিয়া মিলাইয়া যায়! আর বিশ্বামিত্রের ঘরগড়া জগতে যে হতভাগ্য জীবদিগকে বাস করিতে হইত। তাহাদের অবস্থা কী ছিল একবার ভাবিয়া দেখো দেখি! তাহারা তপ্ত ঘিয়ে ময়দার চক্ৰ ছাড়িয়া দিয়া ভাবিতে বসিত ইহা হইতে লুচি হইবে কি চিনির শরবত হইবে! এক গাছ ফল দেখিলেও তাঁহাদের গাছে উঠিয়া পাড়িতে প্ৰবৃত্তি হইত না, সন্দেহ হইত পাছে হাত বাড়াইলেই ওগুলো পাখি হইয়া উড়িয়া যায়। তাহদের বড়ো বড়ো পণ্ডিতেরা মিলিয়া তর্ক করিত পায়ে চলিতে হয় কি মাথায় চলিতে হয়; কিছুই মীমাংসা হইত না। প্রতিবার কি কানে নিশ্বাস লাইব, কেহ বলিত নাকে, কেহ বলিত কানে। অবশেষে একদিন ঠিক দুপুরবেলা যখন সেখানকার অধিবাসীরা ক্ষুধা পাইলে খাইতে হয় কি উপবাস করিতে হয়, এই বিষয়ে তর্ক করিতে করিতে গলদঘর্ম হইয়া উঠিতেছিল, এমন সময়ে হঠাৎ বিশ্বামিত্রের জগৎটা উল্টোপাল্টা, হিজিবিজি, হ-য-ব-র-ল হইয়া, ভাঙিয়া চুরিয়া ফাটিয়া, বোমার মতো আওয়াজ করিয়া, হাউয়ের মতো আকাশে উঠিয়া সবসুদ্ধ কোনখানে যে মিলাইয়া গেল, আজ পর্যন্ত তাহার ঠিকানাই পাওয়া গেল না! তাহার কারণ আর কিছু নয়- সৃষ্ট হওয়ায় এবং নির্মিত হওয়ায় অনেক তফাত । বিশ্বামিত্রের জগৎটা যে অন্যায় হইয়াছিল তা বলিবার জো নাই- তিনি এই জগৎকেই চোখের সুমুখে রাখিয়া এই জগৎ হইতেই মাটি কাটিয়া লইয়া তাহার জগৎকে তাল পাকাইয়া তুলিয়াছিলেন, এই জগতের বেলের খোলার মধ্যে এই জগতের কুলের আঁটি পূরিয়া তাহার ফল তৈরি করিয়াছিলেন; অর্থাৎ এই জগতের টুকরো লইয়া খুব শক্ত শিরীষের আঠা দিয়া জুড়িয়াছিলেন সুতরাং দেখিতে কিছু মন্দ হয় নাই। আমাদের এই জগৎকে যেমন নিঃশঙ্কে আকাশে ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছে, এ আপনার কােজ আপনি করিতেছে, আমার নিয়মে আপনি বাড়িয়া উঠিতেছে, কোনো বালাই নাই, বিশ্বামিত্রের জগৎ সেরূপ ছিল না; তাহাকে ভারি সস্তপণে রাখিতে হইত, রাজর্ষির দিন-রাত্রি তাহাকে তঁহার কেঁচার কাপড়ে বাঁধিয়া লইয়া বেড়াইতেন, এক দণ্ড ছাড়িয়া থাকিতে পারিতেন না। কিন্তু তবু তো সে রহিল না! তাহার কারণ, সে মিথ্যা! মিথ্যা কেমন করিয়া হইল! এইমাত্র যে বলিলাম, এই জগতের টুকরা লইয়াই সে গঠিত হইয়াছে, তবে সে মিথ্যা হইল কী করিয়া ? মিথ্যা নয় তো কী? একটি তালগাছের প্রত্যেক ক্ষুদ্রতম অংশ বজায় থাকিতে পারে, তাহার ছাল আঁশ কাঠ মজা পাতা ফল শিকড় সমস্তই থাকিতে পারে; কিন্তু যে অমোঘ সজীব নিয়মে তাহার নিজ চেষ্টা ব্যতিরেকেও সে দায়ে পড়িয়া তালগাছ হইয়াই উঠিয়াছে, মাথা খুঁড়িয়া মরিলেও তাহার তুলসীগাছ হইবার জো নাই, সেই নিয়মটি বাহির করিয়া লইলে সে তালগাছ নিতান্ত ফাকি হইয়া পড়ে, তাহার উপরে আর কিছুমাত্র নির্ভর করা যায় না! তাহার উপরে যে লোক নির্ভর করিতে পারে, সে কৃষ্ণনগরের কারিগরের গঠিত মাটির কলা খাইতেও পারে- কিন্তু সে কলায় শরীর পুষ্টও হয় না, জিহবা তুষ্টও হয় না, কেবল নিতান্ত কলা খাওয়াই হয়। যাহা বলা হইল তাহাতে এই বুঝাইতেছে যে, অংশ লইয়া অনেক লইয়া সত্য নহে, সত্য একের মধ্যে মূল নিয়মের মধ্যে বাস করে। আমাদের সাহিত্যে নবেল থাকিতে পারে, নাটক থাকিতে পারে, মহাকাব্য গীতিকাব্য খণ্ডকাব্য থাকিতে পারে, সাপ্তাহিক পত্ৰ থাকিতে পারে এবং মাসিক পত্রও থাকিতে পারে। কিন্তু সেই অমোঘ নিয়ম না থাকিতেও পারে, যাহাতে করিয়া নবেল নাটক পত্রপুষ্পের মতো আপনা-আপনি বিকশিত হইয়া উঠিতেছে। আমরা একটি গঠিত সাহিত্য