পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Maier . 8 Se গেলে তাহা অতিশয় অমঙ্গলের নিদান হইয়া উঠে। Agitation করিতে হয় তো করো, কিন্তু দেশের লোকের কাছে করে- দেশের লোককে তাহদের ঠিক অবস্থাটি বুঝাইয়া দাও- বলো যে, গবর্মেন্ট যাহা করিবার তাহা করিতেছেন, কেবল তোমরাই কিছু করিতেছি না! তোমরা শিক্ষা লাভ করো, শিক্ষা দান করো, অবস্থার উন্নতি করো। দেশের যাহা কিছু অবনতি তাহা তোমাদেরই | দোষে, গবর্মেন্টের দোষে নহে। এ কথা বলিবামাত্রই চারি দিকের খুচরা কাগজপত্রে বড গোলমাল উঠিবে- তাহারা বলিবে এ কী কথা! ইংলন্ডে তো এরূপ হয় না, Political Agitation বলিতে তো এমন বুঝায় না, Mazzini তো এমন কথা বলেন নাই; Garibaldi CN আর-এক রকম কথা বলিয়াছেন- Washington-এর কথার সহিত এ কথাটার ঐক্য হইতেছে না, যদি একটা কাজ করিতেই হইল। তবে ঠিক পার্ল্যামেন্টের অনুসারে করাই ভালো ইত্যাদি। উহারাও আবার যদি কথা কহিতে আসে তো কহুক-না, উহাদের মাথা চাষ করিলে বালি ওঠে, আবাদ করিলে কচুও হয় না, অতএব বাঁধি বোলের মহাজনী না করিলে উহাদের গুজরান চলে । না। কিন্তু হৃদয়ের কথা সমস্ত কোলাহল অতিক্রম করিয়া কানের মধ্যে গিয়া পোছাইবেই ইহা নিশ্চয়ই! সেদিন কথোপকথনকালে একজন শ্রদ্ধাস্পদ ব্যক্তি বলিতেছিলেন যে, রোমকেরা যখন প্রাচীন ইংলন্ডের অকালসভ্য শেল্টদিগকে ফেলিয়া আসিয়াছিল, তখন তাহার ইংলন্ডেই পড়িয়াছিল, কিন্তু ইংরাজ যদি কখনো ভারতবর্ষ হইতে চলিয়া যায়, তবে জাহাজে গিয়া দেখিবে বাঙালিরা আগেভাগে গিয়া কাপ্তেন নোয়া সাহেবের পা-দুটি ধরিয়া জাহাজের খোলের মধ্যে চাদর মুড়ি দিয়া গুটিসুটি মারিয়া বসিয়া আছে! আর কেহ যাক না-যাক— আধুনিক বাংলা সাহিত্যটা তো যাইবেই! কারণ ইংরাজি সাহিত্যের গ্যাসলাইট ব্যতীত এ সাহিত্য পড়া যায় না, হৃদয়ের আলোক এখানে কোনো কাজে লাগিবে না, কারণ, ইহা হৃদয়ের সাহিত্য নহে। আমার বাংলা পড়ি বটে। কিন্তু ইংরাজির সহিত মিলাইয়া পড়ি- ইংরাজি চলিয়া গেলে এ বাংলা রাশীকৃত কতকগুলো কালো কালো আঁচড়ে পরিণত হইবে মাত্র! সুতরাং সেই হীনাবস্থা হইতে পরিত্রাণ পাইবার জন্য এ যে আগেভাগে জাহাজে গিয়া চড়িয়া বসিবে তাহার কোনো ভুল নাই- সেখানে গিয়া বাবুর্চিখানার উনুন জ্বালাইবে বটে, কিন্তু তবুও থাকিবে ভালো! অকাল কুম্মাণ্ড কাহাকে বলে জানি না, কিন্তু এরূপ সাহিত্যকে কি বলা যায় না! একটা আশার কথা আছে; এ সাহিত্য চিরদিন থাকিবার নহে। এ সাহিত্য নিজের রোগ নিজে লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছে, এ নিজের বিনাশ নিজে সাধন করিবে- কেবল দুঃখ এই যে, মরিবার পূর্বে বিস্তার হানি করিয়া। তবে মরিবে; অতএব এ পাপ যত শীঘ্ৰ বিদায় হয় ততই ভালো। প্ৰভাত হইবে কবে, নিশাচরের মতো অন্ধকারে কতকগুলা মশাল জ্বালাইয়া তারস্বরে উৎকট উৎসবে না মাতিয়া, নিশীথের গুহার মধ্যে দল বাঁধিয়া বিশৃঙ্খল অস্বাভাবিক উন্মত্ততা না করিয়া কবে পরিষ্কার দিনের আলোতে বিমল-হৃদয়ে আগ্রহের সহিত, সকলে মিলিয়া নূতন উৎসাহে, স্বাস্থ্যর উল্লাসে, সংসারের যথার্থ কাজগুলি সমাধা করিতে আরম্ভ করিব! সেই দিন প্ৰভাতে বাঙালির যথার্থ হৃদয়ের সাহিত্য জাগিয়া উঠিবে, অলসদিগকে ঘুম হইতে জাগাইয়া তুলিবে, নিরাশহৃদয়েরা পাখির গান শুনিয়া প্ৰভাতের সমীরণ স্পর্শ করিয়া ও নবজীবনের উৎসব দেখিয়া নুতন প্ৰাণ লাভ করিবে অর্থাৎ বাংলাদেশ হইতে নিদ্রার রাজত্ব, প্রেতের উৎসব, অস্বাস্থ্যর গুপ্ত সঞ্চরণ একেবারে দূর হইয়া যাইবে। জানি না সে কোন শক কোন সাল, সেই বৎসরই সাবিত্রী লাইব্রেরির যথার্থ গীেরবের সাংবাৎসরিক উৎসব হইবে, সেদিনকার লোক সমাগম, সেদিনকার উৎসাহ, সেদিনকার প্রতিভার দীপ্তি ও কেবলমাত্র বহিস্থিত দর্শকদের জড় কৌতুহলের ভাব নহে যথার্থ প্ৰাণে প্ৰাণে মিলন কল্পনাচক্ষে অস্পষ্ট ছায়ার মতো দেখা যাইতেছে ভারতী চৈত্র ১২৯০