পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৪২০ রবীন্দ্র-রচনাবলী হাতে কলমে প্রেমের ধর্ম এই, সে ছোটোকেও বড়ো করিয়া লয়। আর, আড়ম্বর-প্রিয়তা বড়োকেও ছোটো করিয়া দেখে। এই নিমিত্ত প্রেমের হাতে কাজের আর অন্ত নাই, কিন্তু আড়ম্বরের হাতে কাজ থাকে না। প্রেম শিশুকেও অগ্রাহ্য করে না, বাৰ্ধক্যাকে উপেক্ষা করে না, আয়তন মাপিয়া সমাদরের মাত্রা স্থির করে না। প্রেমের অসীম ধৈৰ্য, যে চারা শত বৎসর পরে ফলবান হইবে, তাহাতেও সে এমন আগ্রহসহকারে জলসেক করে যে, ব্যবসায়ী লোকেরা ফািলবান তরুকেও তেমন যত্ন করিতে পারে না। সে যদি একটা বড়ো কাজে হাত দেয়, তবে তাহার ক্ষুদ্র সোপানগুলিকে হতােদর করে না। প্ৰেম, প্রেমের সামগ্ৰীীর বসনের প্রান্ত চরণের চিহ্ন পর্যন্ত ভালোবাসিয়া দেখে। আর আড়ম্বর ধারাকেও সারা জ্ঞান করে। ছোটো কাজের কথা হইলেই তিনি বলিয়া বসেন, “ও পরে হইবে।” তিনি বলেন, এক-পা এক-পা করিয়া চলাও তো আপামর সাধারণ সকলেই করিয়া থাকে, তবে উৎকট লম্বক্ষ-প্রয়োগ যদি বল। তবে তিনিই তাহা সাধন করবেন। এবং ইতিহাসে যদি সত্য হয় তবে ত্রেতাযুগে তাঁহারই এক পূর্বপুরুষ তাহা সাধন করিয়াছিলেন। তিনি এমন সকল কাজে হস্তক্ষেপ করেন যাহা ‘উনবিংশ শতাব্দীর’ শান্ত্রিসম্মত, ইতিহাসসম্মত, যাহা কনস্টিটুৰ্দশনাল। সমস্ত ভারতবর্ষের যত দুঃখ-দুৰ্দশা, দুর্ঘটনা, দুর্নােম আছে সমস্তই তিনি বালীর লাঙ্গলপাশবদ্ধ দশাননের ন্যায় এক পাকে জড়াইয়া একই কালে ভারতসমুদ্রের জলে চুবাইয়া মারিবেন, কিন্তু ভারতবর্ষের কোনো-একটা ক্ষুদ্র অংশের কোনো-একটা কাজ সে তাহার দ্বারা হইয়া উঠিবে না। বিপুল পৃথিবীতে জন্মিয়া ইহার আর কোনো কষ্ট নাই, কেবল স্থানাভাবের জন্য কিঞ্চিৎ কাতর আছেন। বামনদেব তিনপায়ে তিন লোক অধিকার করিয়াছিলেন, কিন্তু তদাপেক্ষা বামন এই বামনশ্রেষ্ঠের জিহবার মধ্যে তিনটে লোক তিনটে বাতাসার মতো গলিয়া যায়! হিমালয় হইতে কন্যাকুমারী’ ও ‘সিন্ধুনদ হইতে ব্ৰহ্মপুত্রের’ মধ্যে অবিশ্রাম ফু দিয়া ইনি একটা বেলুন বানাইতেছেন; অভিপ্রায়, আসমানে উড়িবেন; সেখানে আকাশ-কুসুমের ফলাও আবাদ করিবার অনুষ্ঠান-পত্ৰ বাহির হইয়াছে। ইনি যদি ইহার উদ্দেশ্য কিঞ্চিৎ সংক্ষেপ করেন সে একরকম হয়, আর তা যদি নিতান্ত না পারেন তবে না হয় খুব ঘটা করিয়া নিদ্রার আয়োজন করুন। হিমালয় নামক উচু জায়গাটাকে শিয়রের বালিশ করিয়া কন্যাকুমারী পর্যন্ত পা ছড়াইয়া দিন, দুই পাশে দুই ঘাটগিরি রহিল। স্থানসংক্ষেপ করিয়া কাজ নাই, কারণ আড়ম্বরের স্বভাবই এই, একবার সে যখন ঘুমায় তখন চতুর্দিকে হাত-পা ছড়াইয়া এমনি আয়োজন করিয়া ঘুমায় সাধ্য তাহাকে জাগায়। তাহার জাগরণও যেরূপ বিকট তাহার ঘুমও সেইরূপ সুগভার। কেবল আড়ম্বর-প্রিয়তার নহে, ক্ষুদ্রত্বেরই লক্ষণ এই যে, সে ক্ষুদ্রের প্রতি মন দিতে পারে না। পিপীলিকাকে আমার যে চক্ষে দেখি ঈশ্বর সে চক্ষে দেখেন না। বড়োর প্রতি যে মনোযোগ বা হস্তক্ষেপ করে, আত্মশ্লাঘা, যশ, ক্ষমতাপ্ৰাপ্তির আশায় সদাসর্বক্ষণ তাহাকে উত্তেজিত করিয়া রাখিতে পারে, সে তাহার ক্ষুদ্রত্বের চরম পরিতৃপ্তি লাভ করিতে থাকে। কিন্তু ছোটাের প্রতি যে মন দেয়, তাহার তেমন উত্তেজনা কিছুই থাকে না, সুতরাং তাহার প্ৰেম থাকা চাই, তাহার মহত্ত্ব থাকা চাই- তাহার পুরস্কারের প্রত্যাশা নাই, সে প্রাণের টানে সে নিজের মহিমার প্রভাবে কাজ * করে, তাহার কাজের আর অন্ত নাই। আত্মপরতা অপেক্ষা স্বদেশ-প্রেম যাহার বেশি সেই প্ৰাণ ধরিয়া স্বদেশের ক্ষুদ্র দুঃখ ক্ষুদ্র অভাবের প্রতি মন দিতে পারে; সে কিছুই ক্ষুদ্র বলিয়া মনে করে না। বাস্তবিকপক্ষে কোনটা ১. ইহা যদি কেহ ‘রুচিবিরুদ্ধ’ বা গালাগালি জ্ঞান করেন তবে আমি উনবিংশ শতাব্দীর” ডাক্লয়িনের 6आदि वि !