পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

880 রবীন্দ্র-রচনাবলী উত্তরোত্তর মাত্রা চড়াইয়া বঙ্কিমবাবুকে আক্রমণ ও গালিগালাজ করিয়াছেন। আক্রমণমাত্রই যে অন্যায় এরূপ আমার বিশ্বাস নহে। আদি ব্রাহ্মসমাজের কতকগুলি মত আছে। উক্ত ব্ৰাহ্মসমাজের দৃঢ় বিশ্বাস যে, সেই সকল মত প্রচার হইলে দেশের মঙ্গল। যদি উক্ত সমাজবতী কেহ সত্যসত্যই অথবা ভ্ৰমক্রমেই এমন মনে করেন যে অন্য কোনো মত তাহদের মত-প্রচারের ব্যাঘাত করিতেছে, এবং দেশের মঙ্গলের প্রতি লক্ষ্য করিয়া যদি সে মতকে খণ্ডন করিবার চেষ্টা করেন, তবে তাহাতে তাহাকে দোষ দেওয়া যায় না এবং তাহাতে কোনো পক্ষেরই ক্ষুব্ধ হইবার কোনো কারণ দেখা যায় না। এইরুপ হওয়াই স্বাভাবিক এবং ভালো, এইরূপ না হওয়াই মন্দ। তবে, গালিগালাজ করা কোনো হিসাবেই ভালো নহে সন্দেহ নাই। এবং সে কাজ আদি ব্রাহ্মসমাজ হইতে হয়ও নাই। তত্ত্ববোধিনীতে বঙ্কিমবাবুর মতের বিরুদ্ধে যে দুইটি প্ৰবন্ধ বাহির হইয়াছে তাহাতে গালিগালাজের কোনো সম্পর্শক নাই। বিশেষত নব্য হিন্দু সম্প্রদায় নামক প্রবন্ধে বিশেষ বিনয় ও সম্মানের সহিত বঙ্কিমবাবুর উল্লেখ করা হইয়াছে। শ্ৰীযুক্ত বাবু কৈলাশচন্দ্ৰ সিংহ নব্যভারতে বঙ্কিমবাবুর বিরুদ্ধে যে ঐতিহাসিক প্ৰবন্ধ লিখিয়াছেন তাহার সহিত আদি ব্ৰাহ্মসমাজের বা ‘জোড়াসাঁকোর ঠাকুর মহাশয়দের’ কোনো যোগই থাকিতে পারে না। তিনি ইচ্ছা করিলে আরও অনেক ঐতিহাসিক প্রবন্ধে আরও অনেক মহারার্থীকে আরও গুরুতররূপে আক্রমণ করিতে পারেন, আদি ব্রাহ্মসমাজের অথবা ঠাকুর মহাশয়দের তাহাকে নিবারণ করিবার কোনো অধিকার নাই। আমি যদি বলি বঙ্কিমবাবু নবজীবনে অথবা প্রচারে যে-সকল প্ৰবন্ধ লেখেন, তাহার এজলাসের সহিত অথবা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটসমাজের সহিত তাহদের সবিশেষ যোগ আছে। তবে সে কেমন শুনায় ? আমার লেখাতেও কোনো গালিগালাজ নাই। দ্বিতীয়ত, আমি যে লেখা লিখিয়াছি তাহা সমস্ত বঙ্গসমাজের হইয়া লিখিয়াছি বিশেষরূপে আদি ব্ৰাহ্মসমাজের হইয়া লিখি নাই। সংক্ষিপ্ত ও তির্যক কটাক্ষপাত করিয়াছেন। সেরূপ কটাক্ষপাতে আমি ক্ষুদ্র প্রাণী যতটা ভীত ও বঙ্কিমবাবু নিতান্তই তরুণ। বোধ করি বঙ্কিমবাবু যখন জীবন আরম্ভ করেন নাই তখন হইতে আদি ব্ৰাহ্মসমাজ নানা দিক হইতে নানা আক্রমণ সহ্য করিয়া আসিতেছেন। কিন্তু কখনোই তেঁাহার ধৈৰ্য বিচলিত হয় নাই। বঙ্কিমবাবু আজ যে বঙ্গভাষার ও যে বঙ্গসাহিত্যের পরম গৌরবের স্থল, আদি ব্ৰাহ্মসমাজ সেই বঙ্গভাষাকে পালন করিয়াছেন সেই বঙ্গসাহিত্যকে জন্ম দিয়াছেন। আদি ব্রাহ্মসমাজ বিদেশীদ্বেষী তরুণ বঙ্গসমাজে যুরোপ হইতে জ্ঞান আহরণ করিয়া আনিয়াছিলেন এবং পাশ্চাত্যালোকে অন্ধ স্বদেশদ্বেষী বঙ্গযুবকদিগের মধ্যে প্রাচীন হিন্দুদিগের ভাব রক্ষা করিয়া আসিয়াছেন; আদি ব্ৰাহ্মসমাজ হিন্দুসমাজপ্রচলিত কুসংস্কার বিসর্জন দিয়াছেন। কিন্তু তৎসঙ্গে সঙ্গে হিন্দুহৃদয় বিসর্জন দেন নাই- এইজন্য চারি দিক হইতে ঝঙ্কা আসিয়া তাহার শিখর আক্রমণ ১. সঞ্জীবনীতে নবজীবনের সূচনা লইয়া যে লেখালেখি চলিয়াছিল তাহার সহিত বঙ্কিমবাবুর কী যোগ কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। যদি বলেন বঙ্কিমবাবু নবজীবনের লেখক তবে সে বিষয়ে আমিও তাহার সহযোগী বলিয়া গর্ব করিতে পারি। অতএব সঞ্জীবনীর উক্ত লেখা আমার প্রতি আক্রমণই বা নহে কেন ? যদি বলেন যে, বঙ্কিমবাবু যে হিন্দুধর্মের ব্যাখ্যা করিতেছেন। উক্ত প্রবন্ধে তাহার প্রতি আক্রমণ করা হইয়াছে, তাহাও ঠিক কথা নহে। নবজীবনের সূচনা নামক প্রবন্ধে যে নবযুগ প্রতিষ্ঠার কিঞ্চিৎ আড়ম্বর করা হইয়াছিল সঞ্জীবনীতে তাঁহারই প্ৰতি লক্ষ্য করা হইয়াছিল। তাহার পর চন্দ্রনাথবাবুতে আর আমাতে যে কিঞ্চিৎ কথা কাটাকাটি হইয়াছিল। সে তাহাতে আমাদের বোঝাপড়া। বঙ্কিমবাবু এই ব্যাপারটি অকারণে কেন নিজের স্কন্ধে তুলিয়া লইলেন কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।