পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Fef 88vo) তো ভালো শেখা হয় না। কে বলে যে হয়। একজামিন পাস হয় সন্দেহ নাই। যদি কেহ বলেন মাঝে মাঝে খেলাধুলা না থাকিলে একজামিনও পাস হয় না, তবে তাহার প্রমাণাভাব। বাঙালির । ছেলের আর যাই দোষ থাক পাস করিতে তাহারা যে পটু এ কথা শত্ৰুপক্ষীয়দিগকেও স্বীকার করতে হয়। তাড়াতাড়ি পাস না করিলে চলে কই? আমাদের টাকাও অল্প, জীবনও অল্প, অথচ দায় অল্প নয়। সৌভাগ্যক্রমে আমার পিতা বর্তমান। তিনি মাসে চল্লিশটি টাকা করিয়া বেতন পান। শীঘ্রই বাধ্য হইয়া পেনশন লাইতে হইবে। আমায় দুটি ছোটাে ভাই আছে। আমি বিদ্যা সমাপন করিয়া কিঞ্চিৎ রোজগার করিলে তবে তাহাদের রীতিমতো অধ্যয়নের কতকটা সুবিধা হইবে। আমি গত বৎসর এল. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছি। এম. এ. পর্যন্ত পড়িয়া একটা যৎসামান্য চাকরি জোটাইতে নিদেনপক্ষে আর পাঁচটা বৎসর মাথা খুঁড়িতে হইবে। ইতিমধ্যে আমার ভগ্নীটিৰ বিবাহ না দিলে নয়। আমরা কায়স্থ। আমাদের ঘর, হইতে মেয়ে বিদায় করিতে হইলে যথার্থই ঘরের লক্ষ্মী বিদায় করিতে হয়। সে যখন যায় ঘর হইতে সোনারুপার চিহ্ন মুছিয়া যায়। উদরের অন্ন উঠাইয়া লইয়া যায়। ঋণদায় গ্রহণ করিয়া কন্যাদায় মোচন করিতে হয়। বাবার মুখে অন্ন রোচে না, রাত্রে নিদশা হয় না। পড়াশুনা আর চলে না, চাকরির চেষ্টা দেখিতেছি। বালকের কাৰ্যাধ্যক্ষের কিংবা কেরানির কিংবা কোনো একটা কাজ খালি যদি হয় তবে হতভাগ্যকে একবার স্মরণ করবেন। ভগ্নীর বিবাহ দিতে হইলে নিজে বিবাহ করিতে হইবে। তাহা হইলে হাতে কিঞ্চিৎ টাকা আসিবে। যে হতভাগ্যের ভগ্নীকে বিবাহ করিব তাহার তহবিলে রসকষ কিছু বাকি থাকিবে না। তাহার পাতে পিপড়ার হাহাকার উঠিবে। আমি সবে এল. এ. পাস করিয়াছি, আমার দর বেশি নয়। বিবাহ করিয়া নিতান্ত বেশি কিছু পাইব না। কিন্তু সংসারের নতুন বোঝার চাপুনি যে মাথায় পড়িবে তাহাতে মাথা তুলিবার শক্তি থাকিবে না। খেলাধুলা ছাড়িয়া কেন যে দিনরাত্রি ব্যাকরণ লইয়া পড়িয়াছি তাহা বোধ করি সম্পাদক মহাশয় এতক্ষণে কিছু বুঝিয়াছেন। কেবল পাস করিলেই চলিবে না, যাহাতে ছাত্রবৃত্তি পাই সে চেষ্টাও করিতে হইবে। আমার মতো ও আমার চেয়ে গরীব ঢের আছে। ছাত্ৰবৃত্তির প্রতি র্তাহারা সকলেই লুব্ধনেত্ৰে চাহিয়া- এমন স্থলে লাঠি ঘুরাইয়া ব্যায়াম করিতে কি ইচ্ছা যায় ? পেটের দায়ে বিলাতে দরজির মেয়েরা খেলা ভুলিয়া সূর্যালোক ও মুক্ত বায়ু ছাড়িয়া কামিজ সেলাই করিতেছে। কবি হুড তাহদের বিলাপগান জগতে প্রচার করিয়াছেন। আমরাও পেটের দায়ে লাঠি ঘুরাইয়া ব্যায়াম করিতে পারি না, দিনরাত্রি ব্যাকরণের দুয়ারে মাথা খুঁড়িতেছি। কই, আমাদের দুঃখের কথা তো কোনো মহাকবি উল্লেখ করেন না। উন্টিয়া স্বাস্থ্যরক্ষার নিয়ম জানি না বলিয়া মাঝে মাঝে ভৎসনা সহিতে হয়। (বোধ করি যত সব স্কুল-পালানে ছেলেই কবি হয়। একজামিনের যন্ত্রণা তাহারা জানে না।) আমি একজন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়েব পরীক্ষাত্তীর্ণ ভালো ইংরাজের কাছে শুনিয়াছি যে সেখানকার দরিদ্র ছেলেরা মাথায় ভিজে তোয়ালে বাঁধিয়া ছাত্রবৃত্তির জন্য যেরূপ গুরুতর পরিশ্রম করে আমরা তাহার সিকিও পারি না। তাহদের অনেকে নীেকার দাঁড় টানে না, ক্রিকেট খেলে না, বই কামড়াইয়া পৰিয়া থাকে। সেখানকার ঠাণ্ডা বাতাসের জোরে টিকিয়া থাকে, পাগল হইয়া যায় না। সেখানকার চেয়ে এখানে এরূপ ছাত্রের সংখ্যা যদি বেশি দেখা যায়। তবে এই বুঝিতে হইবে এখানে দরিদ্রের সংখ্যাও বেশি। এখানকার ছেলেরা যদি আমেরিকার ছেলেদের মতো লাঠি না ঘুরায় তবে তাহাতে আর কাহারো দোষ দেওয়া যায় না, সে দারিদ্র্যের দোষ। ছাত্রদের বুঝিতে বাকি নাই যে ব্যায়ামচচা করিলে শবীর সুস্থ হয় এবং সুস্থ থাকিলেই