পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8G SR - রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী হইয়া উঠে, পূর্বপুরুষ হইতে উত্তরপুরুষে সযত্নে সংক্রামিত হইতে থাকে। এইরূপ সমাদর পাইয়া বিনাসের বীজ মিথ্যা আপন আশ্রয়ের স্তরে স্তরে শিকড় বিস্তার করিতে থাকে, অবশেষে সেই জীর্ণ জর্জর মন্দিরকে সঙ্গে করিয়া ভূমিসাৎ হয়। আমাদের এই দুৰ্দশাপন্ন ভারতবর্ষসেই ভূমিসাৎ জীর্ণ মন্দিরের ভগ্নস্তুপ। কালক্রমে বন্ধনজর্জর সত্য এই ভারতবর্ষে এমনি হীনাসনপ্রাপ্ত হইয়াছিল যে, শুরু, শাস্ত্র এবং প্ৰথাই এখানে সর্বেসর্বা হইয়া উঠিয়াছিল; স্বগীয় স্বাধীন সত্যকে গুরু শাস্ত্ৰ এবং প্রথার দাসত্বে নিযুক্ত হইতে হইয়াছিল। মিথ্যা উপায়ের দ্বারা সত্য প্রচার করিবার ও সহস্ৰ মিথ্যা অনুশাসন দ্বারা সত্যকে বধিয়া রাখিবার চেষ্টা করা হইয়াছিল। বুদ্ধিমানেরা বলিয়া থাকেন মিথ্যার সাহায্য না হইলে সাধারণের নিকটে সত্য গ্ৰাহ্য হয় না, এবং মিথ্যা বিভীষিকা না দেখাইলে দুর্বলেরা সত্যপালন করিতে পারে না। মিথ্যার প্রতি এমনি দৃঢ় বিশ্বাস। ইতিহাসে পড়া যায় বিলাসী সভ্যজাতি বলিষ্ঠ অসভ্যজাতিকে আত্মরক্ষার্থ আপন ভৃত্যশ্রেণীতে নিযুক্ত করিত, ক্ৰমে আসভ্যেরা নিজের ভুল বুঝিতে পারিয়া মনিব হইয়া দাঁড়াইল- সত্যকে মিথ্যার দ্বারস্তু হইতে হইল। সত্যের এইরূপ অবমান দশায় শতসহস্র মিথ্যা আসিয়া আমাদের হিন্দুসমাজে, হিন্দুপরিবারে নির্ভয়ে আশ্রয় লইল কেহ তাহাদিগকে রোধ করিবার রহিল না; তাহার ফল এই হইল সত্যকে দাস করিয়া আমরা মিথ্যার দাসত্বে রত হইলাম, দাসত্ব হইতে গুরুতর দাসত্বে উত্তরোত্তর নামিতে লাগিলাম। আজ আর উত্থানশক্তি নাই- আজ পঙ্গদেহে পথপার্শ্বে বসিয়া ভিক্ষাপাত্ৰ হাতে লইয়া কাতরস্বরে বলিতেছি, ‘দেও বাবা ভিখ দেও!” বালক • S२०२ আপনি বড়ো মুখে যাহারা বড়াই করে তাহারা সুখে থাকে, তাহাদের অল্প অহংকার অল্পেই উদবেলিত হইয়া প্রশমিত হইয়া যায়। কিন্তু মনে মনে যাহারা বড়ো হইয়া বসিয়া আছে, অথচ বুদ্ধির আতিশয্যবশত মুখ ফুটিয়া বলিতে পারে না, তাহাদের অবস্থা সুখের নহে। যেমন বাম্পের ধর্ম ব্যাপ্ত হওয়া, তেমনি অহংকারের ধর্মই প্ৰকাশ পাওয়া। যে তাহাকে অন্তরে আটকে রাখিতে চায় সে তাহার সেই রুদ্ধ অহংকারের অবিশ্রাম আঘাতে সর্বদাই পীড়িত হইতে থাকে। বরং নিজের দুঃখশোক নিজের মধ্যে রোধ করিয়া থাকিলে মহৎ ধৈর্যজনিত একপ্রকার গভীর সুখ লাভ করা যাইতে পারে, কিন্তু চপল অহংকারকে হািদয়ের গোপন কক্ষের মধ্যে শোষণ করিয়া সেই মহত্ত্বের সুখটুকুও পাওয়া যায়] না। যাহারা দুঃখ শোক নীরবে বহন করিয়া সহিষ্ণুতা সঞ্চয় করিয়াছে, তাহদের বিশীর্ণ পাণ্ডুমুখের উপরে একপ্রকার উত্তাপবিহীন জ্যোতির্ময় ছায়া পড়ে, কিন্তু অপরিতৃপ্ত অহংকার যাহাদের হৃদয়-বিবরে ক্ষণে ক্ষণে উষ্ণনিশ্বাস ত্যাগ করিতেছে, তাহাদের নেত্রের অধঃপড়বে একপ্রকার জ্যোতিহীন জ্বালা, তাহদের চিরশীর্ণ তীক্ষ মুখে, দৃঢ়বদ্ধ ওষ্ঠাধরপ্রাস্তে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গভীর রহস্যরেখা সকল প্ৰকাশ পায়। বরঞ্চ যৌবনকালে এই উগ্ৰ প্ৰাখাৰ্য তাহদের সৌন্দর্যের তেমন ক্ষতিকর না হইতেও পারে, কিন্তু প্রৌঢ় বয়সের যে বিমল শান্তিময় মমতাপূর্ণ আচঞ্চল শারদ শোভা তাহা তাহারা কিছুতেই রক্ষা করিতে পারে না। বয়সকালে তাহদের চক্ষুপল্পবে সেই উজ্জ্বল কোমল অশ্রুরেখার ন্যায় ভারাক্রান্ত স্নিগ্ধদৃষ্টি, তাহদের ওষ্ঠ্যাধরে সেই স্নেহভাষায় জড়িত বাসনাহীন সাত্মনাপূর্ণ সুধাধোেত মৃদুহাস্য কিছুতেই প্ৰকাশ পায় না। তাহারা সৌন্দৰ্য প্ৰাণপণে রক্ষা করিতে চায়, কিন্তু তাহাদের হৃদয়ের অন্ধকূপ হইতে কুৎস্থিত বাষ্প অঙ্গে অঙ্গে উখিত হইয়া তাহাদের মুখের সহজ মানব-শোভা লোপ করিয়া দেয়। তাহারা বাৰ্ধক্য গোপন করিতে চায়, অকালে বৃদ্ধ হইয়া পড়ে, অথচ কোনোকালে বার্ধক্যের পরিণত গান্তীর্ঘ লাভ করিতে পারে না।