পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৪৫৬ রবীন্দ্র-রচনাবলী সুন্দর সত্যের প্রতি ধাবমান হওয়া যায়। তাড়াতাড়ি করিতে গেলে আপনার মনের সংকীর্ণ কল্পনার ক্ষুদ্র পারিপাটাটুকু লাভ করা যায়। কিন্তু উদার প্রকৃতির বৃহৎ সামঞ্জস্য দেখা যায় না। টলেমির কাল্পনিক জ্যোতিষ্কমণ্ডল যতই সুবিহিত সুষম হউক-না-কেন সুষমা-সৌন্দর্যে প্রাকৃতিক জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর সহিত তাহার তুলনা হয় না। কাল্পনিক পারিপাট্যের চর্চা করিতে গেলে ক্ৰমে তাহা সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্ম অবস্থা প্রাপ্ত হয়, কারণ বহির্জগৎ হইতে তাহার বাধা নাই এবং তাহার টীকাভাষ্যও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মসূত্ৰে মাকড়সাজালে প্রকৃতি আত্মন্ন হইয়া যায়— তখনই এই কাল্পনিক জগৎই একপ্রকার সত্য হইয়া দাঁড়ায়। দিনের প্রত্যেক মুহুর্তের কার্য নিয়মে বধিয়া দেয় নাই। আমাদের দেশেই এইরূপ অনুশাসন স্বাভাবিক এবং হয়তো আবশ্যক। আমাদের স্বাধীনতা অপহৃত হইলে আমরা বাঁচিয়া যাইনির্ভাবনা বাধা রাস্তায় চলিতে পারি। এমন-কি আমরা নিজের স্বাতন্ত্র্য] রক্ষা করিতে পারি না— এমন স্থলে আমাদের হস্তে যে-কোনো বিষয়ে স্বাধীনতা দিবে। তাঁহাই ক্ৰমে ক্রমে নিতান্তই শিথিল ও উচ্ছঙ্খল হইয়া যাইবে। এইজন্য আমাদের দেশে বাধা নিয়মের প্রাদুর্ভাব এবং নিয়মের দাসত্বকে সাধারণে দুঃখ জ্ঞান করে না। কিন্তু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে বাঁধা নিয়ম করিতে গেলেই সকল অবস্থা ও সকল সময়ের] প্ৰতি দৃষ্টি রাখা অসম্ভব- সকল অবস্থায় সকল সময়েই সকলকেই সকল বিষয়েই একটা মোটামুটি নিয়মের মধ্যে আপনাকে যো-সো করিয়া স্থাপিত করিতে হয়। এইরূপে আমরা হাড়গোড় ভাঙিয়া সকলেই সমান নিবীৰ্য নিজীব... শান্তিসুখ উপভোগ করিতেছি। আর যাহা হীেক বা না হীেক কোনো উপদ্রব নাই। ভাবনা-চিন্তা তর্ক বিতর্কের বদলে] শাস্ত্ৰ আছে এবং পঞ্জিকা আছে। একান্নাবতী পরিবারের মধ্যে পরস্পর পরস্পরকে জড়াইয়া ধরিয়া. করিবার আবশ্যক নাই, ব্যক্তিগত বল সঞ্চয় করিবার প্রয়োজন নাই। কেবল যে প্রয়োজন নাই তাহা নহে, তাহা অন্যায়; একজন নিজের বলে আর-একজনের চেয়ে বেশি মাথা তুলিতে চেষ্টা করিলে আমাদের শান্তিপূর্ণ নিয়মবদ্ধ সমাজের মধ্যে আগাগোড়া একটা গোল উপস্থিত হয়। এইজন্য যখন রাম-রাজত্ব শূদ্ৰক তপশ্চরণাদি দ্বারা আপনাকে. পদবীতে লইয়া যাইবার চেষ্টা করিতেছিলেন তখন দয়াময় রামচন্দ্র সমাজের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া তাহার শিরশেছদন করিলেন। সীতার বনবাস আমাদের এই অতি-নিয়মবদ্ধ সমাজতন্ত্রের একটি দৃষ্টান্তস্থল বলিয়া বোধ হয়। ব্যক্তিগত ন্যায়পরতাও এই সমাজশাসনে পিষ্ট হইয়া যায়- অর্থাৎ ব্যক্তি একেবারেই কেহ নহে... পূর্বেই বলিয়াছি ইহা হইতে এই প্রমাণ হয় যে আমাদের জাতীয় অভিজ্ঞতা হইতে এই স্থির হইয়াছে যে, সামান্য এমন কোনো বিষয় নাই যাহাতে আমরা আপনাকে বিশ্বাস করিতে পারি। খাওয়া শোওয়া সে বিষয়েও হে শাস্ত্ৰ তুমি বলিয়া দাও আমাদিগকে কী করিতে হইবে। কোথাও কিছু যদি ছিদ্র থাকে আমাদের আলস্যবশত ক্ৰমেই সেটা বাড়িয়া উঠিবে। সীতার প্রতি প্রমাণহীন সন্দেহ সেটা একটা ছিদ্র কিন্তু সেটা যদি রাখিতে দাও। তবে আমাদের (জাতীয়) স্বভাবগুণে ক্ৰমে সেটা মস্ত হইয়া উঠিবে। [আজিকার দিনে যে সমস্যা উঠিয়াছে তাহা এই যে এমন লোকদিগকে কী নিয়মে চালনা করা উচিত? ইহারা বিহুদিন] হইতে স্বাধীনতা পায় নাই এবং না পাইবার কারণও ছিল। ইহারা পর্যজাতীয়ের নিকট হইতে যে স্বাধীনতা প্ৰত্যাশা করিতেছে তাহা কি সংগত ? স্বাধীনতা লাভের জন্য কঠোর সাধনা সকল জাতিরই কিরিতে হয়] ... কিন্তু যদি অতি বিশেষ সাধনা কাহারো আবশ্যক থাকে। তবে তাহা ভারতবর্ষীয়ের। কিন্তু ইহারা যদি] কেবলমাত্র আবদার করিয়াই পায় তবে কি তাহা তাহদের জাতীয় জীবনের মধ্যে তাহদের হাড়ে হাড়ে প্ৰবেশ] করিতে পাইবে? তাহা কি তাহারা যথার্থ পাইবে, না বাহিরে দেখিতে হইবে যেন পাইল ? দ্বিতীয় কথা। আমরা যে যথার্থই স্বাধীনতা চাহি তাহা জানিবার উপায় কী? যাহা আমাদের