পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

3 Գ8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী না, তাহা হইলে তাহার প্রস্তর-মুর্তি এত দিনে ইংলন্ডের চিত্রশালায় শ্রদ্ধার সহিত রক্ষিত হইত। যে ঔদার্যের সহিত আলেকজান্ডার পুরুরাজের ক্ষত্রিয়োচিত স্পর্ধা মার্জনা করিয়াছিলেন, সেই ঔদার্যের সহিত তাতিয়া টোপীকে ক্ষমা করিলে কি সভ্যতাভিমানী ইংরাজ জাতির পক্ষে আরও গীেরবের বিষয় হইত না? যাহা হউক ইংরাজেরা এই অসামান্য ভারতবর্ষীয় বীরের শোণিতে প্রতিহিংসারাপ। পশু-প্রবৃত্তি চরিতার্থ করিলেন। আমরা সিপাহি যুদ্ধ সময়ের আরও অনেক বীরের নামোল্লেখ করিতে পারি, যাহারা ইউরোপে জন্মগ্রহণ করিলে,ইতিহাসের পৃষ্ঠায়, কবির সংগীতে, প্রস্তরের প্রতিমূর্তিতে, অভ্ৰভেদী স্মরণস্তম্ভে অমর হইয়া থাকিতেন। বৈদেশিকদের লিখিত ইতিহাসের একপ্ৰান্তে তাহদের জীবনীর দুই-এক ছত্ৰ অনাদরে লিখিত রহিয়াছে, ক্ৰমে ক্ৰমে কালের স্রোতে তাহাও ধৌত হইয়া যাইবে এবং আমাদের ভবিষ্যবংশীয়দের নিকট তাহদের নাম পৰ্যন্ত অজ্ঞাত থাকিবে। শঙ্করপুরের রাণা বেণীমাধু লর্ড ক্লাইভের আগমনে নিজ দুর্গ পরিত্যাগ করিলেন এবং তঁহার ধন সম্পত্তি অনুচরবর্গ কামান ও অন্তঃপুরচারিণী স্ত্রীলোকদিগকে সঙ্গে লইয়া অযোধ্যার বেগম ও বির্জিস কাদেরের সহিত যোগ দিলেন। তিনি তাহাদিগকেই আপনার অধিপতি বলিয়া জানিতেন, এই নিমিত্ত তাহাদিগকে রাজার ন্যায় মান্য করবেন বলিয়া প্ৰতিজ্ঞা করিয়াছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাহার এই প্ৰতিজ্ঞা পালন করিয়াছিলেন। ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট তাহাকে তাহার রাজ্য প্রত্যাৰ্পণ করিতে চাহিলেন, তাহাকে মৃত্যু-দণ্ড হইতে অব্যাহতি দিবেন বলিয়া অঙ্গ স্বীকার করিলেন, তাহার ক্ষতিপূরণ করিতে প্ৰস্তুত হইলেন এবং তাহার কষ্টের কারণ অনুসন্ধান করিবেন বলিয়া স্বীকৃত হইলেন, কিন্তু রাজা সমুদয় প্রস্তাব তুচ্ছ করিয়া বেগম ও র্তাহার পুত্রের জন্য টেরাই প্রদেশে আশ্রয়হীন ও রাজ্যহীন হইয়া ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন। বেণীমাধু জীবনের বিনিময়েও তাহার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেন নাই এবং ইংরাজদের হস্তে কোনো মতে আত্মসমর্পণ করেন নাই। রাজপুত বীর নহিলে আপনার প্রতিজ্ঞা পালনের জন্য কয়জন লোক এরূপ ত্যাগাস্বীকার করিতে পারে? রয়ার রাজপুত অধিপতি, নৃপৎসিং খঞ্জ ছিলেন। তিনি যুদ্ধের সময় প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন যে, ‘ঈশ্বর আমার একটি অঙ্গ লইয়াছেন, অবশিষ্ট অঙ্গগুলি আমার দেশের জন্য দান করিব।” কিন্তু আমরা সর্বাপেক্ষা বীরাঙ্গনা ঝানসীর রানী লক্ষ্মীবাইকে ভক্তিপূর্বক নমস্কার করি। তাহার যথার্থ ও বিস্তারিত ইতিহাস পাওয়া দুষ্কর, অনুসন্ধান করিয়া যাহা পাওয়া গেল তাঁহাই লিপিবদ্ধ করিয়া পাঠকদিগকে উপহার দিলাম। লর্ড ড্যালকুসি ঝানসী রাজ্য ইংরাজশাসনভুক্ত করিলেন, এবং ঝানসীর রানী লক্ষ্মীবাইয়ের জন্য অনুগ্রহ করিয়া উপজীবিকাস্বরূপ যৎসামান্য বৃত্তি নির্ধারিত করিয়া দিলেন। এই স্বল্প বৃত্তি রানীর সম্রাম-রক্ষার পক্ষে যথেষ্ট ছিল না, এই নিমিত্ত তিনি প্রথমে গ্ৰহণ করিতে অস্বীকৃত হন, অবশেষে অগত্যা তাহাকে গ্ৰহণ করিতে হইল। কিন্তু ইংরাজ কর্তৃপক্ষীয়েরা ইহাতেই ক্ষাত হইলেন না, লক্ষ্মীবাইয়ের মৃত স্বামীর যাহা-কিছু ঋণ ছিল তাহা রানীর জীবিকা হইতে পরিশোধ করিতে লাগিলেন। রানী ইহাতে আপত্তি করিলেন, কিন্তু তাহা গ্রাহ্য হইল না। ইংরাজেরা তাহার রাজ্যে গো-হত্যা আরম্ভ করিল, ইহাতে রাজী ও নগরবাসীরা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইয়া ইহার বিরুদ্ধে আবেদন করিল। কিন্তু তাহীও গ্রাহ্য হইল না। এইরূপে রাজ্যহীনা, সম্পত্তিহীনা, অভিমানিনী রাজী নিষ্ঠুর অপমানে মনে মনে প্রতিহিংসার অগ্নি পোষণ করিতে লাগিলেন এবং যেমন শুনিলেন কোম্পানির সৈনিকেরা বিদ্রোহী হইয়া উঠিয়াছে, অমনি তাহার অপমানের প্রতিশোধ দিবার জন্য সুকুমার দেহ রণসজায় সজ্জিত করিলেন। লক্ষ্মীবাই অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন। তাহার বয়ঃক্রম বিংশতি বৎসরের কিছু অধিক, তাহার দেহ যেমন বলিষ্ঠ মনও তেমনি দৃঢ় ছিল। রাস্ত্রী অতিশয় তীব্রুবুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন। রাজ্যপালনের জটিল ব্যাপার সকল অতিসূন্দরােরাপে