পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ws রবীন্দ্র-রচনাবলী তাহাই হইবে।” নিৰ্ভয়ে খাঁচার মধ্যে প্রবেশ করিয়া তিনি বাঘকে ডাকিয়া বলিলেন- ‘ওহে তুমি তো মিঞা সাহেবের বাঘ, একবার যশোবস্তের বাঘের কাছে এসো দেখি!” এই বলিয়া চোখ রাঙাঁইয়া তিনি বাঘের দিকে চাহিলেন। হঠাৎ কী কারণে বাঘের এমনি ভয় হইল যে, সে মুখ ফিরাইয়া লেজ গুটািইয়া সুড়সুড়ি করিয়া কোণে চলিয়া গেল। রাজপুত বীর কহিলেন, ‘যে-শত্ৰু ভয়ে পালায় তাহাকে তো আমরা মারিতে পারি না। তাহা আমাদের ধর্মবিরুদ্ধ।' এই আশ্চর্য ঘটনা দেখিয়া বাদশা তাহাকে পুরস্কার দিয়া ছাড়িয়া দিলেন। বাঘেরা অত্যন্ত ভয়ানক জানোয়ার বটে। কিন্তু এক-এক সময়ে তাহারা হঠাৎ অত্যন্ত সামান্য কারণে কেমন ভয় পায়। একটা গল্প বোধ করি তোমরা সকলে শুনিয়া থাকিবে- একদল ইংরাজী সুন্দরবনে শিকার করিতে গিয়াছিলেন। যখন আহারের সময় হইল, বনের মধ্যে আসন পাতিয়া সকলে আহারে বসিয়া গেলেন। এমন সময়ে জঙ্গলের ভিতর হইতে একটা বাঘ লাফ দিয়া তাহাদের কাছে আসিয়া পড়িল। বাঘ দেখিয়া একটি মেমসাহেব তাড়াতাড়ি ছাতা খুলিয়া তাহার মুখের সামনে ধরিলেন। হঠাৎ অদ্ভুত একটা ছাতা-খোলার ব্যাপার দেখিয়া বাঘের এমনি ভয় লাগিল যে সেখানে অধিকক্ষণ থাকা সে ভালো বোধ করিল না, চটপট ঘরে ফিরিয়া গেল। এমন শোনা যায় বাঘের চোখের দিকে একদৃষ্টি চাহিয়া থাকিলে বাঘ আক্রমণ করিতে সাহস করে না। এটা লোকের মুখে শোনা কথা। কথাটার সত্যমিথ্যা ঠিক বলিতে পারি না। নিজে পরখ করিয়া যে বলিব এমন সুবিধাও নাই সাধও নাই। পরখ করিতে গেলে ফিরিয়া আসিয়া বলিবার সাবকাশ না থাকিতে পারে। নাহর খাঁর আর-একটা গল্প বলি। রাজপুতদের একপ্রকার খেলা আছে। ঘোড়ায় চড়িয়া একটা গাছের নীচে দিয়া ঘোড়া ছুটাইয়া দিতে হয়। ঘোড়া যখন ছুটিতেছে তখন গাছের ডাল ধরিয়া কুলিতে হয়, ঘোড়া পায়ের নীচে দিয়া চলিয়া যায়। বাদশাহের এক ছেলে একবার নিহর খাকে এই খেলা খেলিতে হুকুম করেন। নাহর রাগিয়া উঠিয়া বলিলেন, “আমি তো আর বঁােদর নই। রাজা যদি খেলা দেখিতে ইচ্ছা করেন তো লড়াই করিতে হুকুম দিন একবার তলোয়ারের খেলাটা দেখাইয়া দিই।” বাদশার পুত্ৰ বলিলেন- "আচ্ছা, তুমি সৈন্য লইয়া সিরোহীর রাজা সুরতনকে ধরিয়া লইয়া আইস।” নাহর রাজি হইলেন। সিরোহীর রাজা আচলগড় নামক তার এক পর্বতের দুর্গের মধ্যে লুকাইয়া রহিলেন। নাহর বাছা-বাছা একদল লোক লইয়া গভীর রাত্রে গোপনে দুর্গের মধ্যে গিয়া রাজাকে নিজের পাগড়ির কাপড়ে। বঁধিয়া ফেলিলেন। রাজাকে এইরূপে বন্দী করিয়া নহর তাহাকে দিল্লীতে নিজের প্রভু যশোবন্ত সিংহের নিকট আনিয়া দিলেন। বিশোবন্ত সুরতানকে বাদশার সভায় লইয়া যাইবেন স্থির করিলেন এবং সেইসঙ্গে কথা দিলেন যে বাদশাহের সভায় কেহ তাহকে কোনোরাপ অপমান করিতে পরিবে না। সিরোহীর রাজাকে আরঞ্জীবের সভায় লইয়া যাওয়া হইল। দস্তুর আছে যে বাদশাহের সভায় গেলে বাদশাহকে সকলেরই নত হইয়া সেলাম করিতে হয়। সেই দস্তুর অনুসারে সকলে সুরতানকে সেলাম করিতে বলিল। তিনি সদৰ্পে মাথা তুলিয়া বলিলেন- “আমার প্রাণ বাদশাহের হাতেকিন্তু আমার মান আমার নিজের হাতে। কখনো কোনো মানুষের কাছে মাথা নোয়াই নাই কখনো নোয়াইব না।” সভার লোকেরা আশ্চর্য হইয়া গেল। কিন্তু যশোবস্তের প্রতিজ্ঞা স্মরণ করিয়া কেহ। তাহাকে কিছু বলিল না। তাহারা একটা কৌশল করিল। একটি ছোটাে দরজার মতো ছিল তাহার মধ্য দিয়া গলিতে হইলে মাথা নীচু না করিলে চলে না- সেই দরজার ভিতর দিয়া তাহাকে বাদশাহের সম্মুখে যাইতে বলিল। কিন্তু পাছে মাথা হােঁট হয় বলিয়া তিনি আগে পাগলাইয়া দিয়া মাথা বাহির করিয়া আনিলেন। বাদশাহ রাজার এই নিভীকতায় রাগ না করিয়া সল্পষ্ট হইয়া বলিলেন, “তুমি কোন রাজ্য পুরস্কার চাও আমি দিব।” রাজা তৎক্ষণাৎ বলিলেন, “আমার অচলগড়ের মতৈা রাজ্য আর কোথায় আছে, সেইখানেই আমাকে ফিরিয়া যাইতে দিন৷” বাদশাহ সন্তষ্ট হইয়া তাহাঁই অনুমতি করিলেন। এই রাজা এবং রাজবংশ চিরদিন আপনাদের স্বাধীনতা