পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

¢ፃS রবীন্দ্র-রচনাবলী শিখরে দাঁড়াইয়া থাকেন, চারিদিকের ছোটােখাটাে খুঁটিনাটি অতিক্ৰম করিয়া তাহারা দেখিতে পান। ক্ষুদ্রসকল বৃহৎ হইয়া আঁহাদিগকে বাধা দিতে পারে না। তাঁহাদের বৃহত্ত্বাবশত চতুর্দিক হইতে তীহারা বিচ্ছিন্ন আছেন বলিয়াই চতুর্দিকের প্রতি তাহদের প্রকৃত মমতা আছে। যে ব্যক্তি সংসারের আবর্তের মধ্যস্থলে ঘুরিতেছে, সে কেবল আপনার সহিত পরের সম্বন্ধ দেখিতে পায়, কিন্তু মহৎ যে সে আপনা হইতে বিযুক্ত করিয়া পরকে দেখিতে পায়, এইজন্য পরকে সেই বুঝিতে পারে। কাজ সেই করিতে পারে। হাতের শৃঙ্খল সেই হিড়িয়াছে। প্রত্যেক পদক্ষেপে সে ব্যক্তি সহস্ৰ ক্ষুদ্রকে অতিক্রম করিতে না পারে, প্রত্যেক ক্ষুদ্র উচু-নিচুতে যাহার পা বাধিয়া যায় সে আর চলিবে কী করিয়া। সংসারের সুখে-দুঃখে যাহারা ভারাক্রান্ত, সংসারপথের প্রত্যেক সূচ্যগ্র ভূমি তাহাদিগকে মাড়াইয়া চলিতে হয়। এইজন্য ঘর হইতে আঙিনা তাহাদের বিদেশ, আপনার সাড়ে-তিন হাতের বাহিরে তাহদের পর। এইজন্যে তাহারা দূরদেশের কথা, জগতের বৃহত্ত্বর কথা, সত্যের অসীমত্বের কথা বিশ্বাস করিতে পারে না। আপনার খোলসটির মধ্যে তাহদের সমস্ত বিশ্বাস বন্ধ। অসীম জগৎ-সংসারের অপেক্ষা আপনার চারিদিকের বাঁশের বেড়া ও খড়ের চাল তাহদের নিকট অধিক সত্য। শোকে আমাদের সংসারের ভার লাঘব করিয়া দেয়, আমাদের চরণের বেড়ি খুলিয়া দেয়, সংসারের অবিশ্ৰাম মাধ্যাকর্ষণ রাজ্জ্ব যেন ছিন্ন করিয়া দেয়। আমরা সংসারের সহিত নির্লিপ্ত হই। এইজন্য শোকে আমরা মহত্ত্ব উপাৰ্জন করি। এইজন্য বিধবারা মহৎ । এইজন্য বিধবারা সংসারের কাজ অধিক করিতে পারে। মানুষের মধ্যে উদারতা এবং সংকীর্ণতা দুই থাকা চাই, কারণ তাহাই স্বাভাবিক। উদারতা এবং সংকীর্ণতার মিলনে জগৎ সৃষ্ট। অসীম ভাব সীমাবদ্ধ আকারে প্রকাশ হওয়ার অর্থই জগৎ । পঞ্চােত্ব প্রাপ্ত হওয়ার অর্থ মৃত্যু, একত্ব প্রাপ্ত হওয়ার অর্থ জীবন। অর্থাৎ, পঞ্চ একে পরিণত হওয়া, বৃহৎ ক্ষুদ্রে পরিণত হওয়াই সৃষ্টি। অতএব একাধারে ক্ষুদ্র বৃহৎ, উদারতা সংকীর্ণতা থাকাই স্বাভাবিক, ইহার বিপরীত হওয়াই অস্বাভাবিক। প্রকৃতিতে আকর্ষণ-বিকর্ষণ মেলামেশা করিয়া থাকে, কেন্দ্রানুগ এবং কেন্দ্রাতিগশক্তি একসঙ্গে কাজ করে, ঐক্য এবং অনৈক্য এক গৃহে বাস করে। দুই বিপরীতের মিলনই এইবিশ্ব। মনুষ্য এই বিশ্ব-নিয়মের বহিরে থাকে না। মনুষ্যও বৃহৎ এবং ক্ষুদ্রের মিলনস্থল। মনুষ্য, আপনাত্ব না থাকিলে, পরের দিকে যাইতে পারে না, সীমাবদ্ধ না হইলে সে অসীমের জন্য প্রান্তত হইতে পারে না, অনন্তকালে থাকিলে সে কোনোকালে হইতেই পরিত না। So আমরা বন্ধ না হইলে মুক্ত হইতে পাই না। ইংরেজিতে যাহাকে Freedom বলে তাহা আমাদের নাই, বাংলায় যাহকে স্বাধীনতা বলে তাহা আমাদের আছে। কঠিনতর অধীনতাকেই স্বাধীনতা লািগল কুখ্য সর্বািন্ধলা সুখ। কিন্তু পরের অধীন হওয়াইসিয়ে আপনার অষ্টম স্বাধীনতার অর্থ আপনার অর্থাৎ একের অধীনতা, অধীনতার অর্থ পরের অর্থাৎ সহস্রের অধীনতা। যাহার গৃহ নাই, তাহাকে কখনো গাহুতলে, কখনো মাঠে, কখনো খড়ের গাদায়, কখনো দয়াবানের কুটিরে আশ্ৰয় লইতে হয়; যাহার গৃহ আছে সে সংসায়ের অসংখ্যার মধ্যে ব্যাকুল নহে; তাহার এক ধ্রুব আশ্ৰয় আছে। যে নৌকা হালের অধীন নহে সে কিছু স্বাধীন বলিয়া গর্ব করিতে পারে না, কারণ সে শতসহস্র তরঙ্গের অধীন। যে দ্রব্য পৃথিবীর ভারাকর্ষণের অধীনতাকে উপেক্ষা করে, তাহকে প্রত্যেক সামান্য বায়ুহিল্লোলের অধীনতায় দশ দিকে ঘুরিয়া মরিতে হইবে। অসীম জগৎসমূদ্র অগণ্য অঙ্গ, এখানে স্বাধীনতা ব্যতীত আমাদের গতি নাই।