পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

विविक्ष । Ørክrዓ বাষ্প করিয়া এত সূক্ষ্ম করিয়া দিয়াছেন যে, সোনা আর নাই কেবল তাহার লাবণ্যের দ্বারা চারি দিক আচ্ছন্ন হুইয়া গিয়াছে। বায়ু-হিল্লোলের মধ্যে একটি চিরপরিচিত স্পর্শ প্রবাহিত হইতে থাকে, কাজকর্ম ভুলিয়া যাইতে হয়; বেলা চলিয়া যাইতেছে, না মন্ত্ৰমুগ্ধ আলস্যে অভিভূত হইয়া পড়িয়া আছে, বুঝা যায় না। শরতের প্রভাতে যেন আমার বহুকালের স্মৃতি একত্রে মিশিয়া ৰূপান্তরিত হইয়া রক্ত আকারে আমার হৃদয়ের শিরার মধ্যে সঞ্চারণ করিতে থাকে। কবিতার মধ্যে অনেক সময়ে এইরূপ স্মৃতিজাগরণের কথা লেখা হয়, সে কথা সকল সময়ে ঠিক বোঝা যায় না- মনে হয় ও একটা কবিতার অলংকার মাত্র। হৃদয়ের ঠিক ভাবটি ভাষায় প্রকাশ করা এমুনি কঠিন কাজ! বাঁশির শব্দে, পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায়, কবিরা বলেন, হৃদয়ের মধ্যে স্মৃতি জাগিয়া উঠে। তাহাকে স্মৃতির অপেক্ষা বিস্মৃতি বলিলেই ঠিক হয়। কিন্তু যে বিস্মৃতি বলিলে একটি অভাবাত্মক অবস্থা বোঝায় এ তাহা নয়, এ একপ্রকার ভাবাত্মক বিস্মৃতি। নহিলে বিস্মৃতি জাগিয়া উঠা” কথাটা ব্যবহার হইতেই পারে না। এরূপ অবস্থায় স্পষ্ট যে কিছু মনে পড়ে তাহা ভাবমাত্র অনুভব করা যায়। যে-সকল স্মৃতি স্বাতন্ত্র্য পরিহার করিয়া একাকার হইয়াছে, যাহাদিগকে পৃথক করিয়া চিনিবার জো নাই, আমাদের হৃদয়ের চেতনরাজ্যের বহির্ভাগে যাহারা বিস্মৃতি-মহাসাগররূপে স্তব্ধ হইয়া শয়ান আছে, তাহারা যেন এক-এক সময়ে চঞ্চল ও তরঙ্গি ত হইয়া উঠে; তখন আমাদের চেতনাহাদয় সেই বিস্মৃতি-তরঙ্গের আঘাত অনুভব করিতে থাকে, তাহাদের রহস্যময় অগাধ প্ৰবল অস্তিত্ব উপলব্ধ হয়, সেই মহা বিস্মৃতি, অতি বিস্তুত বিপুলতার ক্ৰন্দনধবনি শুনিতে পাওয়া যায়। শরৎকালের সূর্যালোকে আমার এইরূপ অবস্থা হয়। দুই-একটা জীবনের ঘটনা, দুই-একটা অতীতকালের মধুর শরৎ মনে পড়ে, কিন্তু সেইসঙ্গে যে-সকল শরৎকাল মনে পড়ে না, যেসকল ঘটনা ভুলিয়া গিয়াছি, সেইগুলিই যেন অধিক মনে পড়ে। বছর তিন-চারের পূর্বে একটি শরৎকাল আমি অন্তরের সহিত উপভোগ করিয়াছিলাম। বাড়ির প্রান্তে একটি ছোট ঘরে একটি ছােট্ট ডেস্কের সম্মুখে বাস করিতাম। আরও দুটি-একটি ছোট আনন্দ আমার আশেপাশে আনাগোনা করিত। সে বৎসর যেন আমার সমস্ত জীবন ছুটি লইয়াছিল। আমি সেই ঘরটুকুর মধ্যে থাকিয়াই জগতে ভ্ৰমণ করিতাম, এবং বহির্জগতের মধ্যে থাকিয়াও ঘরের ভিতরটুকুর মধ্যে যে স্নেহপ্রেমের বিন্দুটুকু ছিল তাহা একান্ত আগ্রহের সহিত উপভোগ করিতাম। আমি যেন একপ্রকার আত্মবিস্মৃত হইয়াছিলাম। মনের উপর হইতে সমস্ত ভার চলিয়া গিয়া, আমি একপ্রকার লঘুভাবে জগতের সমস্ত মধুরতার মধ্য দিয়া অতি সহজে সঞ্চরণ করিতাম। বোধহয় সেই বৎসরই শরৎকালের সহিত আমার প্রথম বন্ধুভাবে পরিচয় হইয়াছিল। এক মুহূর্তের জন্য প্রগাঢ় সুখ অনুভব করিলে, সেই মুহূৰ্তকে যেমন আর মুহূর্ত বলিয়া মনে হয় না- মনে হয় যেন তাহার সহিত অনন্তকালের পরিচয় ছিল, বোধহয় আমারও সেইরূপ এক শরৎকাল রাশীকৃত শরৎ হইয়া উঠিয়াছে। আমি সেই শরতের মর্মের মধ্য দিয়া যেন বহুসহস্ৰ সুদূর শরৎপরম্পরা দেখিতে পাই- দীর্ঘ পথের দুই পার্শ্ববতী বৃক্ষশ্রেণী যেমন অবিচ্ছিন্ন সংহতভাবে দেখা যায়, সেইরূপে- অৰ্থাৎ সবসুদ্ধ মিলিয়া একটা নিবিড় শারদ আনন্দের ভােবরাপে। আমার মনে হয় স্বভাবতই শরৎকাল স্মৃতির কাল এবং বসন্ত বর্তমান আকাঙ্ক্ষার কাল। *সতে নবজীবনের চাঞ্চল্য, শরতে অতীত সুখদুঃখময় জীবনের পূর্ণতা। বাল্যকাল না গেলে যেন *ারতের অতলস্পর্শ প্রশান্তি অনুভব করা যায় না।