পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা VANS) সাহিত্য। গতবর্ষের ১৩০৪] মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্রের সাহিত্য একত্রে হস্তগত হইল। বাংলায় আজকাল ইতিহাসের আলোচনা সাহিত্যের অন্য সকল বিভাগকে অতিক্ৰম করিয়া উঠিয়াছে, ‘সাহিত্য’ পত্রের সমালোচ্য তিন সংখ্যা তাহার প্রমাণ। মাঘের পত্রে “রাজা টােডরমল, "রানী ভবানী’ এবং ‘বাংলার ইতিহাসে বৈকুণ্ঠ এই তিনটি প্ৰবন্ধ প্রধান স্থান অধিকার করিয়াছে। “রানী ভবানী” একটি ঐতিহাসিক গ্ৰন্থ, অনেক দিন হইতে খণ্ডাকারে সাহিত্যে বাহির হইতেছে। ‘বৈকুণ্ঠ” প্রবন্ধে লেখক শ্ৰীযুক্ত কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর প্রতি ইতিহাসের অন্যায় অভিযোগ সকল ক্ষালনের চেষ্টা করিয়াছেন। নবাবী আমল সম্বন্ধে প্ৰচলিত ইতিহাসের চূড়ান্ত বিচারের উপরেও যে আপিল চলিতে পারে সুযোগ্য লেখক মহাশয় তাহা প্রমাণ করিয়াছেন। আমাদের মনে ক্রমে সংশয় জন্মিতেছে যে, বাল্যকালে বহুকষ্টে যে কথাগুলো মুখস্থ করিয়াছি, শ্ৰীেঢ়বয়সে আবার তাহার- প্ৰতিবাদগুলি মুখস্থ করিতে হয় বা! পরীক্ষাশালা হইতে নিৰ্গত হইয়া ওগুলো যাহারা ভুলিতে পারিয়াছেন তাহারাই সৌভাগ্যবান। ফাল্গুন ও চৈত্রের সাহিত্যে রানী ভবানী’, ‘মগধের পুরাতত্ত্ব’ এবং ‘রত্নাবলীর রচয়িতা শ্ৰীহৰ্ষ’ এই তিনটি ঐতিহাসিক প্ৰবন্ধ সর্বাপেক্ষা অধিক স্থান ও মাহাত্ম্য লাভ করিয়াছে। কোন শ্ৰীহৰ্ষরত্নাবলী-রচয়িতা বলিয়া খ্যাত তাহার নির্ণয়ে লেখক শ্ৰীযুক্ত সতীশচন্দ্র রায় যথেষ্ট অনুসন্ধান প্ৰকাশ করিয়াছেন। সহযোগী সাহিত্যে” লেখক মহাশয় সমালোচনা সম্বন্ধে যে কয়েকটি উপদেশ দিয়াছেন তাহাতে লেখকসম্প্রদায় পরম উপকৃত হইবেন। আমরা তাহা উদধূত করিলাম। ‘অম্মদেশে সাহিত্যসেবা নিতান্তই শখের জিনিস; তজ্জন্য সাহিত্যসেবীরাও অসাধারণ সূক্ষ্মচমী। কেহ আমাদিগের রচনার সমালোচনা করিয়া কেবল প্ৰশংসা না করিয়া কোনোরাপ দোষ দেখাইলে আর আমাদিগের সহ্য । হয় না। আমরা তাহার প্রতিবাদে সমালোচকের যুক্তির বিরুদ্ধে যুক্তি না দেখাইয়া তাহার উপর কেবল গালিবর্ষণ করি। আমাদিগের আত্মীয়, বন্ধুরা আশ্ৰিত অনুগতদিগের মধ্যে কেহ সমালোচককে গালি দিবার ভার গ্রহণ না করিলে আপনারাই মাসিকপত্রে প্রবন্ধ লিখিয়া বা সভা ডাকিয়া, সমালোচককে গালি দিয়া আদর্শের ক্ষুদ্রতা, উদ্দেশ্যের হীনতা ও হৃদয়ের নীচতার পরিচয় প্রদান করি, এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর পরিতৃপ্তি অনুভব করিয়া থাকি। আবার আমাদের “লিটারারি’ মোসাহেবগণ আমাদের এইরূপ কাৰ্যকেও মহৎ কাৰ্যবলিয়া আমাদিগকে আত্মদোষের বিষয়ে অন্ধ করিতে ক্ৰটি করে না।” এরূপ তীব্র ভাষায় এরূপ অনুতাপ-উক্তি আমরা দেখি নাই। কিন্তু লেখক নিজের প্রতি যতটা কালিমা প্রয়োগ করিয়াছেন তাহার প্রয়োজন ছিল না। কারণ সূক্ষ্মচর্ম কেবল তাহার একলার নহে, প্রায় লেখকমাত্রেরই। এবং তিনি আত্মশ্লানির প্রাবল্যবশত লেখকবৰ্গ সম্বন্ধে যে কথা বলিয়াছেন ঠিক সেই কথাই সমালোচকদিগকেও বলা যায়। সকল লেখাও নির্দোষ নহে, সকল সমালোচনাও অশ্ৰান্ত নহে। কিন্তু মাংসাশী প্রাণীর মাংস যোেরাপ ভক্ষ্য নহে, সেইরূপ সমালোচকের সমালোচনা সাহিত্যসমাজে অপ্রচলিত। সমালোচনার উপযোগিতা সম্বন্ধে কাহারও মতভেদ হইতে পারে না। কিন্তু দুৰ্ভাগ্যক্রমে সমালোচকের প্রবীণতা অভিজ্ঞতা ও উপযুক্ত শিক্ষা অভাবে আমাদের দেশের সমালোচনা অনেক স্থলেই কেবলমাত্র উদ্ধত স্পর্ধার সূচনা করে, এবং কেমন করিয়া নিংসিংশয়ে জানিব যে তাহ আদর্শের ক্ষুদ্রতা, উদ্দেশ্যের হীনতা ও হৃদয়ের নীচতার পরিচয় প্রদান করে না? যে লেখকের কিছুমাত্র পদাৰ্থ আছে আঁহার স্বপক্ষ বিপক্ষ দুই দলই থাকিবে- বিপক্ষ দল স্বপক্ষকে বলেন স্তাবক, এবং স্বপক্ষ দল বিপক্ষকে বলেন নিন্দুক; সমালোচ্য প্রবন্ধের লেখকও কোনো এক পক্ষকে লক্ষ্য করিয়া ‘মোসাহেব ‘স্তাবক বলিতে কুষ্ঠিত হন নাই। অধিকাংশ স্থলেই ভক্তকে “স্তাবক এবং বিরক্তকে নিন্দুক বলে তাহারাই, যাহারা সত্য প্রচার করিতে চাহেনা, বিদ্বেষ প্রকাশ করিতে চায়। কিন্তু লেখক যখন বিশ্বসাধারণের বিশেষ হিতের জন্য সমালোচনার উপকারিতা সম্বন্ধে নিরতিশয় পুরাতন ও সাধারণ সত্য প্রকাশ করিতে প্ৰবৃত্ত, কোনো ব্যক্তিবিশেষকে আক্রমণ করা তাহার উদ্দেশ্যনহে তখন এ-সকল বিদ্বেষপূর্ণ অত্যুক্তি অসংগত শুনিতে হয়।