পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাময়িক সারসংগ্ৰহ . ܝ” ' * Gł আয়ত্ত হইতে-না-হইতেই সেই ভাষাতেই যদি বিষয় শিক্ষা দিবার উপক্রম করা যায়। তবে তাহাতে ভাষা শিক্ষা এবং বিষয়শিক্ষা উভয়েরই ব্যাঘাত হয়। না বুঝিয়া অনবরত মুখস্থ করিতে যে সময় ও শক্তির অপব্যয় হয় তাহাঁই রীতিমতো ভাষাশিক্ষায় প্রয়োগ করলে উক্ত শিক্ষা অনেক পরিমাণে সম্পূর্ণতা লাভ করে। যাহারা এককালে দুই হাতে দুই লাঠি লইয়া খেলে, তাহারা শিক্ষাকালে প্ৰথমে স্বতন্ত্রভাবে প্রত্যেক হাতের অভ্যাস করিয়া পরে দুই হাত মিলাইয়া লয়। সেইরূপ, আমাদের মতে, অন্তত এস্ট্রোন্স পর্যন্ত ভাষা এবং বিষয়কে স্বতন্ত্ররূপে আয়ত্ত করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উভয়কে একত্র মিলাইয়া লওয়া কর্তব্য। শিক্ষা এবং পরীক্ষা দুই ভাষায় হইলে যাহা ইংরাজিতে শিক্ষা করি তাহা বাংলায় এবং যাহা বাংলায় শিখি তাহা ইংরাজিতে পরখ করিয়া লওয়া যায়- নতুবা মুখস্থ বিদ্যার অন্তরালে যে সুগভীর শূন্যতা থাকিয়া যায় তাহার আবিষ্কার এবং সংশোধন করিবার কোনো উপায় দেখা যায় না। । জাতীয় সাহিত্য “জাতীয়” শব্দ ব্যবহার করিয়াছি বলিয়া “সাহিত্য”-সম্পাদক মহাশয় আমাদের প্রতি কিঞ্চিৎ শ্লেষ কটাক্ষপাত করিয়াছেন। প্রথমত, অনুবাদটি আমাদের কৃত নহে; এই শব্দ বহুকাল হইতে বাংলা সাহিত্যে ন্যাশনাল শব্দের প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে। দ্বিতীয়ত, ভাষার পরিণতি সহকারে স্বাভাবিক নিয়মে অনেকগুলি শব্দের অর্থ বিস্তৃতি লাভ করে। সাহিত্য’ শব্দটি তাহার উদাহরণস্থল। সাহিত্য-সম্পাদক মহাশয়ও সাহিত্য শব্দটিকে ইংরাজি লিটারেচর’ অর্থে প্রয়োগ করিয়া থাকেন। সম্পাদক মহাশয় সংস্কৃতজ্ঞ, ইহা তাহার অবিদিত নাই যে, লিটারেচার শব্দের অর্থ যতদূর ব্যাপক, সাহিত্য শব্দের অর্থ ততদূর পৌঁছে না। শব্দকল্পদ্রুম অভিধানে সাহিত্য’ শব্দের অর্থ এইরূপ নির্দিষ্ট হইয়াছে : মনুষ্যকৃত শ্লোকময় গ্রন্থবিশেষঃ । সি তু ভট্টি রঘু কুমারসম্ভব মাঘ ভারবি মেঘদূত বিদগ্ধমুখমণ্ডন শান্তিশতক প্রভূতয়ঃ।’ এমন-কি, রামায়ণ-মহাভারতও সাহিত্যের মধ্যে গণ্য হয় নাই, তাহা ইতিহাসরূপে খ্যাত ছিল। এইজন্য মহারাষ্ট্রীয় ভাষায় সাহিত্য’ শব্দের পরিবর্তে ‘বাঙাময়’ শব্দ ব্যবহৃত হইয়া থাকে। রঘুবংশের তৃতীয় সর্গে ২৭শ শ্লোকে আছে : লিপেষথাবদ গ্রহণেন বাঙ্ময়ং অর্থাৎ রঘু লিপিবদ্ধ নদীপথ দিয়া বাঙ্ময়রাপ সমুদ্রে প্রবেশ করিলেন। ‘জাতি’ শব্দ এবং ‘নেশন’ শব্দ উভয়েরই মূল ধাতুগত অর্থ এক। জন্মগত ঐক্য নির্দেশ করিবার জন্য উভয় শব্দের উৎপত্তি। আমরা ব্ৰাহ্মণ প্রভৃতি বৰ্ণকে জন্মগত ঐক্যবশত জাতি বলি আবার বাঙালি প্রভৃতি প্ৰজাবৰ্গকেও সেই কারণেই জাতি বলিয়া থাকি। জাতি শব্দের শেষোক্ত প্রয়োগের স্থলে ইংরাজিতে ‘নেশন’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। যথা, বাঙালি জাতি-বেঙ্গলি নেশন। এরূপ স্থলে ন্যাশনাল' শব্দের প্রতিশব্দরূপে “জাতীয়’ শব্দ ব্যবহার করাতে বিশেষ দোষের কারণ দেখা যায় না। আমরাও তাহাঁই করিয়াছি। কিন্তু সম্পাদক মহাশয় অকস্মাৎ অকারণে অনুমান করিয়া লইয়াছেন যে আমরা জাতীয় সাহিত্য’ শব্দে ‘ভর্ন্যাকুলের লিটারেচর” শব্দের অপূর্ব তৰ্জমা করিয়াছি। বিনীতভাবে জানাইতেছি। আমরা এমন কাজ করি নাই। সাহিত্য যে কেবলমাত্র ব্যক্তিগত আমোদ বা শিক্ষাসাধক নহে, তাহা যে সমস্ত জাতির ‘জাতীয়’ বন্ধন দৃঢ়তর করে, বাংলা সাহিত্য, যে বাঙালি জাতির ভূত ভবিষ্যৎকে এক সজীব সচেতন নাড়ি-বন্ধনে বধিয়া দিয়া তাহাকে বৃহত্তর এবং ঘনিষ্ঠতর করিয়া তুলিবে— আমাদের প্রবন্ধে এই প্রসঙ্গের বিশেষরূপ অবতারণা ছিল বলিয়া, আমরা বাংলা সাহিত্যকে, ব্যক্তিগত রসসম্ভোগের হিসাবে