পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট S বিচ্ছিন্ন করি না। সেইরাপ— যদি ভারতবাসীর অন্তঃকরণ আমি ঠিক বুঝিয়া থাকি- তাহারাও বিশেষ ধারা অথবা বিশেষ আইনের প্রচলন সম্বন্ধেই আপত্তি প্ৰকাশ করে- কিন্তু ব্রিটিশ শাসন যে ভারতের পক্ষে হিতকারী তাহা অস্বীকার করিবার কোনো লক্ষণ কোথাও দেখা যায় না, এবং যখন একটি উদধূত রচনায় দেখিলাম লেখক বলিতেছেন, যে, বর্তমান অবস্থায়- ব্রিটিশ রাজ্যের ধবংস নহে- প্ৰত্যুত তাহার স্থায়িত্বই ভারতবর্ষের সকল আশার আশ্রয়স্থান- তখন আমি বিস্ময় এবং বিস্ময়ের সহিত আনন্দ উপভোগ করিয়াছি। ভালো, যখন এত দূরই অগ্রসর হইয়াছ, অথচ অনিবাৰ্য অবস্থাবৈষম্যবশত যখন সমস্ত ভারতবর্ষে স্বায়ত্ত রাজ্যবিধির মূল সূত্রপাত করিতেও যথেষ্ট দ্বিধা উপস্থিত হয়, তখন অন্তত এটুকু অঙ্গীকার করিতেই হইবে যে, যাহা আমরা দান করিব তাহা আমরা প্ৰত্যাখ্যান করিব না; সুতরাং, আমাদের স্বরাজ্যতন্ত্রে আমরা যে সর্বোচ্চ উপকারগুলি ভোগ করি, অর্থাৎ প্ৰজাগণ যে-সকল রাজকাৰ্যবিধিতে ঔৎসুক্যবান তাহাকে প্ৰকাশ্যতা দান করা, এবং অন্যায় ও ভ্ৰম হইতে রক্ষা পাইবার জন্য বিচার ও আলোচনার উদ্দেশে তাহাকে যথেষ্ট সময় দেওয়া- সেই অধিকার যখন আমরা ভারতবর্ষকে দান করিয়াছি; তখন বর্তমান ঘটনায় ভারতবর্ষীয় গবর্মেন্টের নিরতিশয় শঠকারিতা ও একান্ত গোপনতা পরম দুঃখের বিষয় হইয়াছে ; বিশেষত যখন এই ত্বরাতিশয্য ও মন্ত্রগুপ্তি কেবলমাত্র কোনো আংশিক সংশোধন ও পরিবর্তন-উদ্দেশে নহে, পরন্তু দেশীয় সংবাদপত্র সম্বন্ধে একটি গুরুতর আইনস্থাপনা উপলক্ষে - কনফারেন্সের গত অধিবেশনের পর আমরা আমাদের দেশের প্রবীণা মহানারীর মৃত্যুশোক অনুভব করিয়াছি- সেই কাশিমবাজারের রানী স্বর্ণময়ী যাঁহার দেশবিশ্রুত সদগুণ, ভারতবর্ষেরই সর্বসম্মত বিশেষ সদগুণ, দয়া। তাহার সেই দয়ায় প্রাচ্য দেশের মুক্তহস্ত বদ্যান্যতা এবং প্রতীচ্যভাগের অর্থনৈতিক দূরদর্শিতা একত্রে মিশ্রিত হইয়াছিল। এক্ষণে আমাদের এই সভার প্রথম কর্তব্য, বাংলার নূতন শাসনকর্তাকে স্বাগত সম্ভাষণ। সার জন্য বুডুবর্ন যে সর্বপ্রকার ত্যাগষীকারে উন্মুখ ইতিমধ্যে তিনি তাহার প্রমাণ দিয়াছেন, গুরুতর সংকটের সময় রাজনীতিকে তিনি প্রজাদের প্রার্থনার অনুকুল করিয়াছেন। তাহার মন্ত্ৰগৃহের আসনে বসিয়া তিনি অঙ্গীকার করিয়াছেন যে, শিল্পশিক্ষাপ্রাপ্ত দেশীয় লোকদিগকে সাহায্য করিবার জন্য তিনি প্ৰস্তুত এবং তিনি রাষ্ট্রীয় ব্যয় সংক্ষেপের উপায় উদভাবনের জন্য মন্ত্রসভার বেসরকারি মন্ত্রীগণকে বিশেষরূপে অনুরোধ করিয়াছেন। এইরূপে সার জন বাংলা দেশের ভবিষ্যৎকে আশার আলোকে উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়াছেন। বৎসরটি দুৰ্দৈবের বৎসর চলিতেছে। ভূমিকম্পের আন্দোলনের মধ্যে গত কনফারেন্সের অধিবেশন সমাপ্ত হইয়াছিল। বঙ্গদেশের গাত্ৰ হইতে দৈবনিগ্রহের ক্ষতচিহ্নগুলি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত না হইতেই পরে পরে দুৰ্ভিক্ষ এবং মারীর আবির্ভাব হইল। বিধাতার বিধানে অশুভ হইতেও শুভ ফল উৎপন্ন হয়। গত দুর্ভিক্ষে তাহার পরিচয় পাওয়া গিয়াছে। সেই অন্নাভাবের দিনে বিপন্ন ভারতের প্রতি জগতের সর্বত্র হইতেই করুণা বর্ষিত হইয়াছে। পৃথিবীর বৃহৎ জাতির সহিত যে আমাদের এক বন্ধন আছে তাহা তাহারা এই উপলক্ষে স্বীকার করিয়াছেন এবং আমরাও তাহা হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করিতে পারিয়াছি। কিন্তু প্লেগে যেন কতকটা তাহার বিপরীত ফল ফলিয়াছে; ইহাতে দুই জাতির হৃদয়বন্ধনে যেন কঠোর আঘাত করিয়াছে। রাজা-প্ৰজার পরস্পর বুঝাপড়ার অভাব হওয়াই তাহার মূল এবং শাসিত ও শাসনকর্তার মধ্যে অবাধ বার্তাবহনের অসম্পূর্ণতাই তাহার কারণ। জনসাধারণের স্বাভাবিক নেতাগণ, যে, বার্তা প্রদানে বিরত ছিলেন তাহা নহে, কিন্তু গবর্মেন্ট তাহাদিগকে মন্ত্রণায় আহ্বান না করায় সর্বসাধারণেও তাঁহাদের প্রতি সম্পূর্ণ নির্ভর করিতে পারে নাই। বোম্বাইয়ের দুর্বিপাক হইতে শিক্ষা লাভ করিয়া সার জন্য যে রাজনীতির অবতারণা করিয়াছেন