পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৭৩৬ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী রহিয়াছে যে তাহাতে তোমার শরীরের প্রয়োজনীয় স্থায়িত্ব বিধান হইতেছে অথচ তাহার স্বাধীন গতিবিধির কিছুমাত্র ব্যাঘাত হইতেছে না- তোমার শরীরের মাংসপেশীর গঠন প্ৰণালী অনুযায়ী, পরিশ্রম এবং বিশ্রামের প্রয়োজন অনুসারে আলোক এবং অন্ধকার পর্যায়ক্রমে যাতায়াত করিতেছে- তোমার শরীরের প্রয়োজন অনুসারে, ছয় ঋতু যথাসময়ে পরিবর্তিত হইতেছেএই সমস্ত উপযোগিতার নিদর্শন পাইয়া, তুমি কি ক্ষশকাল মাত্ৰও সন্দেহ করিতে পাের, যে তোমার বাসের জন্যই এই পৃথিবী সৃষ্ট হইয়াছে? তবে যদি আমরা বিজ্ঞানের সাহায্যে জানিতে পারি যে আমাদের এই পৃথিবীর ন্যায় প্রত্যেক গ্রহই, নিয়মিত-কাল-মধ্যে সূর্যের চতুর্দিকে পরিভ্রমণ করে- পৃথিবীর ন্যায় আলোক, উত্তপ, বায়ু এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্ৰী দ্বারা সুসম্পন্ন- একই নিয়মে তথায় আলোক-অন্ধকারের পৰ্যায় উপস্থিত হইতেছে- ঋতুর পরিবর্তন হইতেছে- শীতোত্তাপের বিভিন্নতা হইতেছেজলভূমির সুচারু বিভাগ সম্পাদিত হইতেছে- তখন কি ওই-সকল গ্ৰহগণ সর্বপ্রকারে আমাদেরই মতো জীবপুঞ্জের যে আবাসভূমি এ বিষয়ে আর সংশয় হইতে পারে? তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা পৌষ ১৭৯৬ শক। ১২৮০ বঙ্গাব্দ বঙ্গে সমাজ-বিপ্লব বিশৃঙ্খলা অধিকদিন তিষ্ঠিতে পারে না। প্রাকৃতিক ঘটনায় এক-একটা যে বিপ্লব বিশৃঙ্খলা দেখিতে পাওয়া যায়, সে-সকল প্রকৃতির কার্য শৃঙ্খলারই একটি অঙ্গ। বিপ্লব-বিশৃঙ্খলার অর্থই এই যে, এখন যে অবস্থা আছে ইহা এখনকার সময়ের উপযোগী নহে। ইহা পরিবর্তিত না হইলে সমূহ অনিষ্ট হইবে। বর্তমানে যখনই বিপ্লব দেখিব, তখনই জানিব যে, ভূতকালের যে ভিত্তির উপর দাঁড়াইয়া আছি, তাহা জীৰ্ণ বা অকৰ্মণ্য হইয়া গিয়াছে, ভবিষ্যতে পুনঃ-সংস্কার হইবে। যেখানকার বায়ু লঘু হইয়া যাইবে, সেইখানেই চারি দিক হইতে বায়ুর স্রোত আসিয়া একটি ঝটিকা বাধিবে বটে, কিন্তু তাহার ফল এই হইবে যে, বায়ু পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থা প্রাপ্ত হইবে। মনুষ্যের সামাজিক রাজ্যেও সেইরূপ এক-এক সময় ঝঙ্কা ঝটিকা বহিতে থাকে, তখন সকলেই ভয় করেন যে, বুঝি সমাজের সমুদয় শৃঙ্খলা উলটাপালট হইয়া যায়। কিন্তু তাঁহাদের ভয় করিবার কোনো কারণ নাই ; তাহারা যদি ভবিষ্যৎ দেখিতে পাইতেন, তো দেখিতেন যে, জীর্ণ সমাজের কতক কতক ভগ্ন ও চূর্ণ হইয়া গিয়াছে বটে, কিন্তু আবার দৃঢ়তর উপাদানে নূতন সমাজ নির্মিত হইয়াছে। রাজপুরুষের একাধিপত্য অনেকদিন য়ুরোপ-খণ্ডে চলিয়া আসিতেছিল, হয়তো ততদিন প্রয়োজন ছিল, কিন্তু যখনই সে সময় অতীত হইয়া গেল, আমনই একটা বিপ্লব বাধিল; দারুণ রক্তপাত, অরাজকতা, অত্যাচার উপস্থিত হইল, কিন্তু পরিণামে তাহা হইতে অশুভ ফল উৎপন্ন হইল না। অসভ্য অবস্থায় অসাধারণ পরাক্রমশালী প্রভুর প্রয়োজন ছিল, নচেৎ তখনকার দুর্দাঁত লোকেরা যুক্তিতে বা সুমিষ্ট ব্যবহারে বশ হইত না, কিন্তু সে অবস্থা চলিয়া গেলে সে নিয়ম খাটিল না। এক কথায় বলিতে গেলে বিপ্লব আপাতত অতিশয় বিকটাকার বোধ হইলেও পরিণামে তাহা হইতে অনেক শুভ ফল উৎপন্ন হয়। লন্ডনে যখন দারুণ মড়ক হইয়াছিল, তখন যে অগ্নিদাহ হয়, তাহা হইতে যদিও অনেক অনিষ্ট ঘটিয়াছিল, কিন্তু মড়কের বীজ দগ্ধ হইয়া গুরুতর অনিষ্ট নিরাকৃত হয়। বঙ্গদেশের প্রাচীন লোকেরা সািভয়ে দেখিতেছেন যে, নূতন বংশের অভু্যুত্থানশীল যুবকদের মধ্যে অতিশয় বিপ্লব চলিতেছে। তাহারা ভাবিতেছেন, কলির সন্ধ্যাকাল বুঝি উপস্থিত হইয়াছে; কেহ কহাকে মানে না, সকলে স্বস্ব প্রধান, স্বদেশ-সম্বন্ধে অভিজ্ঞ বৃদ্ধদের কাছে তাহারা পরামর্শ