পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ8Եr রবীন্দ্র-রচনাবলী যাত্ৰাভঙ্গ’ । শক্রির শুভযাত্রা ভঙ্গ করা সৰ্ব্বথা কর্তব্য হইতে পারে; কিন্তু, নিজের নাসিকাটিও তো নেহাত নিষ্কর্ম দ্রব্য নহে। নাসিকাটির কি একেবারেই কোনো মূল্য নাই যে, নির্মম হইয়া তাহাকে নিমূল করিবে? কিন্তু, পরিতাপ এ-দেশীয় পেট্রিয়টেরা, প্রকৃত প্ৰস্তাবে তাহাঁই করিয়াছেন, অথচ পূর্ণমাত্রায় তাহা কাহারো যাত্রাভঙ্গের প্রতিবন্ধক হয় নাই। বিদেশীয় বস্ত্রশিল্পের শুভযাত্রা সম্যকরূপে ভঙ্গ হইবে না; আদীে এক বিন্দু ভঙ্গ হইবে কি না সে বিষয়ে সম্পূর্ণ সন্দেহ; কিন্তু স্বদেশীয় সূত্ৰ-শিল্পের ও সুলভ বন্ত্রের নাসিকাটি নিশ্চিন্তপুরে পলায়ন করিয়াছে। নাসিকাছেদনজনিত যন্ত্রণায় এখন রোদন করা বৃথা। যাতনার তীব্রতার সঙ্গে এক রাত্তি তামাশাও আছে। নাসা না থাকা নিজেই এক তামাশা বটে; কিন্তু, এ ব্যাপারে তদাতিরিক্ত আর-একটু তামাশা আছে। নাসিকাটি কোথা হইতে কতখানি স্থান পর্যন্ত কর্তিত হইয়াছে, তাহার সহিত অন্য কোনো অঙ্গের হানি হইয়াছে কি না, আমাদের পরিচালক ও পেট্রিয়টবৃন্দ, তাহা এখনও নাকে হাত দিয়া দেখেন নাই। সেই সামগ্ৰীটি গিয়াছে গিয়াছে’, বলিয়াই কেবল রোদন ও রোষ প্ৰকাশ করিতেছেন। কেন গেল, কাহার দোষে গেল, কত দূর লইয়া গিয়াছে, নাসিকা পুনঃপ্রাপ্তির কোনো সম্ভাবনা নাই, তবুও তো এ-সকল কথা এখন অনায়াসে নিশ্চিন্তভাবে ভাবিয়া দেখা যাইতে পারে। অনর্থক চিৎকারে ও চাঞ্চল্য প্রকাশেই কি পুরুষাৰ্থ? গত বৎসর ফেব্রুয়ারির শেষে লর্ড এলগিনের রাজত্ব আরম্ভ। তাহার অভিষেকের অব্যবহিত পরেই প্ৰাথমিক ব্যবস্থাপক বৈঠকে বাজেটের আলোচনা। অর্থের অনটন ; অর্থাগমের অন্যতম উপায় উদ্ভাবন— ট্যারিফ ট্যাক্সের পুনঃ সংস্থাপন। ক’মাসেরই বা কথা; সকলেরই ইহা স্মরণ আছে এবং সে স্মৃতি এখনও খুব টাটকা আছে। বিদেশ ও বিলাত হইতে আমদানি বহু দ্রব্যের উপর কর বসিল; কেরোসিন তৈলের ট্যাক্স বাড়িল। পেট্রিয়টগণ পুলকিত হইলেন। ইনকম ট্যাক্স হইতে ও নরক গমন করিতে হইবে না বলিয়া কেহ, পরস্তু স্বদেশীয় শিল্পী ও শ্রমজীবীদিগের সুবিধার স্বপ্ন কল্পনা করিয়া কেহ ; নানা জনে নানা অনুমানে আনন্দিত হইলেন। কিন্তু এই সবিশেষ কোনো সম্বন্ধ ছিল না। দেশের অনিবার্য ব্যবহার্য দ্রব্যের উপর আমদানি-শুস্ক সংস্থাপনে সজীব জাতির যেরূপ আনন্দ উৎপন্ন হয়, তাহা আমেরিকার ইতিবৃত্তেই জ্ঞাতব্য। আনন্দই বটে ! সে আনন্দে অস্ত্ৰনিৰ্ঘোষ, রাষ্ট্রবিপ্লব ও শোণিতস্রোতেরই সম্ভাবনা। কিন্তু অঙ্গহীন অসাড় জাতির সবই উল্টা। পক্ষাঘাতে পাঁচটি ইন্দ্ৰিয়ই বিকল, কাজেই হৰ্ষ-বিষাদের কারণ অনুভবে অক্ষম। বুদ্ধিবৃত্তিও তদনুরূপ সূক্ষ্ম; সংসারের সংবাদ রাখেন তেমনি সবিশেষ; সুতরাং আমদানি-শুল্কে উপরোক্ত আমোদ অনুভূত হইয়াছিল। সে আমোদের যদি একান্তই কোনো কারণ নির্দেশ করিতে হয়— তাহার একটা কারণ হুজুগ; আর-একটা কারণ 'হবি' । বাতিকের অশ্ব আরোহণ করিয়া অহরহ ইন্দ্ৰলোকে গমনের চেষ্টা। ইহাই হবি”। সংসারে হবিওয়ালা লোকের অভাব নাই, হুজুগওয়ালা তো অসংখ্য। সুতরাং সেই জাতীয় লোকের মধ্যেই ওই আমদানি-শুল্কে আনন্দের উদ্ৰেক হইয়াছিল। নহিলে যাহারা সংসারের সবিশেষ সংবাদ রাখেন, বাজারের বৃত্তান্ত বুঝিয়া অপক্ষপাতে বিচার করিতে পারেন এবং দেশের অস্থি মজ্জা মেধা, দরিদ্র রায়ত ও কৃষকের সুখদুঃখের একটা অস্তিত্ব অনুভব করেন, তাহদের কেহই এই আমদানি-শুঙ্কে সন্তুষ্ট হন নাই। উহাতে দেশের অন্তর্ভেদী একটি অসন্তোষই উৎপন্ন হইয়াছে। দেশের লােক অদৃষ্টবাদী বল ওবাক-শক্তি-বিরহিত তেজন্যই এ অসন্তোষ অস্ফুট ও অব্যক্ত; সংবাদপত্রে উঠে নাই, বাগীর বক্তৃতায় ফুটে নাই, বলে বণিকের পণ্য-পাট লুষ্ঠিত হয় নাই। লোকের বাকশক্তি ও বল থাকিলে ফল অন্যরাপ হইত। এই অস্তর্ভেদী অব্যক্ত অসন্তোষের কারণ অতীব স্পষ্ট। পেটিয়টিজমের প্রিয় হিবি।” যাহাই হউক, ইহা পরিষ্কার ও প্রতিদৈনিক প্রত্যক্ষ ঘটনা যে, স্বদেশীয় বা বিলাতি বিদেশীয়ও হউক, যে দ্রব্য জনসমাজে অনিবাৰ্যভাবে চলিয়া গিয়াছে, যাহা জীবনধারণোপকরণের