পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় Ae) অভিভূত করে; কৈকেয়ীর সমীপে রামের আজ্ঞাকারিতা অসাধারণ বীরপুরুষের লক্ষণ বলিয়া মনে হয়। সৈন্যেরা যে সেনাপতির দাসত্ব করে, পুত্র যে পিতার দাসত্ব করে, সে দাসত্ব মহত্ত্বেরই লক্ষণ; একটি গান আছে। “ভয় করিলে যাঁরে না থাকে অন্যের ভয়’;- সেনাপতির দাসত্ব করিলে শত্রুর দাসত্ব-শৃঙ্খলে বদ্ধ হইতে হয় না, পিতার দাসত্ব করিলে অজ্ঞাতি-কুলশীল যে-সে লোকের দাসত্বশৃঙ্খলে বদ্ধ হইতে হয় না; একজন জার্মান বক্তা বলিয়াছেন, Liberty I am thy slave- এ দাসত্ব যেমন, পিতার কাছে দাসত্বও সেইরূপ উচ্চ দরের দাসত্ব। এইরূপ মহত্ত্ব-সূচক দাসত্ব যিনি যত অভ্যাস করেন তিনি তত নীচত্ব-সূচক দাসত্বের হস্ত হইতে দূরে অবস্থিতি করেন- দুই দাসত্বের মধ্যে আকাশ পাতাল প্ৰভেদ। এই তো গেল শব্দের মার-প্যাচ- এখন আসল কথাটা কী দেখা যাক- লেখকের অভিপ্রায় এই যে, রাম কৈকেয়ীর আজ্ঞা লঙ্ঘন করিতে পারেন না বলিয়া কৈকেয়ীর কি কর্তব্য যে, তিনি রামকে বনে পাঠান? এখন- রামের গুরুজন বলিলে অগ্ৰে কৌশল্যা সুমিত্ৰা দশরথ বশিষ্ঠ প্রভৃতিকেই মনে পড়ে- কৈকেয়ীকে শুরুজনের ওঁচা বলিয়া মনে হয়। এ স্থলে দেখা উচিত যে, কৈকেয়ী আপনার ক্ষমতার অপব্যবহার করিয়াছে বলিয়া সাধারণত রামের গুরুজন তাহার জন্য দায়ী নহেন। এমনি- কোথায় কোন গুরুজন আপনার ক্ষমতার অপব্যবহার করিয়াছে বলিয়া সাধারণত সকল গুরুজন সে দোষে দোবী হইতে পারে না; কিন্তু লেখক বলেন সাধারণত গুরুজনদিগের স্ব স্ব ক্ষমতার অপব্যবহার করিবারই কথা- না করেন তো সে ছোটােদের পরম সৌভাগ্য। ক্ষমতার অপব্যবহার করা মনুষ্যের স্বভাবসিদ্ধ এই মূল তত্ত্বটির উপর দাঁড়াইয়া লেখক শুরুজনদিগের প্রতি ঘোরতর কটাক্ষপাত করিতেছেন, তিনি বলেন “মনুষ্যজাতি স্বভাবত ক্ষমতার অন্ধ উপাসক। যে পক্ষে ক্ষমতা সেই পক্ষে আমাদের সমবেদনা আর অসহায়ের আমরা কেহ না, এইজন্যই একজনের হাতে যথেচ্ছ ক্ষমতা থাকিলে অত্যন্ত ভয়ের বিষয়। তাহার ব্যবহারের ন্যায়ান্যায় বিচার করিবার লোক সংসারে পাওয়া যায় না, কাজে তাহাকে আর বড়ো একটা ভাবিয়া চিন্তিয়া কাজ করিতে হয় না। যাহাদের বিবেচনা করিয়া চলা বিশেষ আবশ্যক সংসারের গতিকে এমনই হইয়া দাঁড়ায় যে, তঁহাদেরই বিবেচনা করিয়া চলিবার কম প্রবর্তন হয়, এই গুরুজন সম্পর্কেই একবার ভাবিয়া দেখো-না। আইন যত বাধাবাধি যত কড়াকড়ি সমস্তই কি কনিষ্ঠদের উপরে না ?” এ স্থলে বক্তব্য এই যে, ক্ষমতার অপব্যবহার যেমন মানুষ্যের স্বভাবসিদ্ধ, ছোটোদের প্রতি স্নেহও তেমনি মানুয্যের স্বভাবসিদ্ধ- বিশেষত ঘরের ছেলেদের প্রতি- আপনার ছেলেদের তো কথাই নাই। দুষ্ট বালকেরা অনেক জায়গায় শুরুজনদিগেরই মেহকে সহায় করিয়া শুরুজনদিগেরই প্রতি অবাধ্যতাচরণ করে- তাহারা মনে মনে বলে, “হিন্দ মারিাবেন নয়। বকিবেন ফাসি তো আর দিবেন। না’- গুরুজনদিগের স্নেহ তাহদের প্রভুতাকে ছাপাইয়া উঠে- ইহা কলা বাহুল্য। মেহের বাঁধ অতিক্ৰম করিয়া ক্ষমতার অপব্যবহার মাল-মোকদ্দামা স্থলেই দেখিতে পাওয়া যায়- ওইরূপ বিশেষ বিশেষ স্থলে যাহা হয় তাহা সাধারণত সকল স্থলেই সংলগ্ন হইতে পারে না। অদ্যপি এমন কোনো সমাজ-তত্ত্ববিৎ জন্মগ্রহণ করিয়াছেন কি না সন্দেহ যাহাকে না মানিতে হইয়াছে যে- সমাজ-তত্ত্বের অতি অল্পই তাহদের বুদ্ধির আয়ত্তাধীন। সামাজিক সকল তত্ত্বেরই দুই দিক আছে এবং দুই দিকেই ভালো মন্দ দুইই আছে; এক দিকের ভালো এক দেশে শোভা পায়, আর-এক দিকের ভালো আর-এক দেশে শোভা পায়, এক দিকের ভালো এক কালে শোভা পায়, আর-এক দিকের ভালো আর-এক কালে শোভা পায়; এ ভিন্ন সকল দিকের ভালো একই দেশে একই কালে শোভা পাইবে কি সম্ভবই নহে। ইংলন্ডে প্ৰভু যে দাসকে আজ্ঞা না করিয়া অনুগ্রহ করিতে বলেন তাহার ভালোর দিকটাই লেখক মতেই মিল খায় না- আমাদের দেশের গৃহস্থের চাকরিবাকিরদের তুই-তোকারি করে রটে কিন্তু তাহার মধ্যে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভাব দূরে থাকুক স্নেহ-বাৎসল্যেরই প্ৰাবল্য দৃষ্ট হয়- আমাদের