পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় । . ԳծԳ 'লাঠির পরে লাঠি" লেখক আমারিই লাঠি ঘুরাইয়া আমাকেই বিলক্ষণ শিক্ষা দিয়াছেন। তাহার লাঠি খেলার চমৎকার কৌশল,-"তাঁহার বাক্য বিন্যাসের ঘাটা, তাহার রসিকতার ছটা আমাদের মুখ হইতে বারংবার বাহবা বাহির করিয়াছে। আমাদের দেশের দরিদ্র বালকদের অবস্থাদি সম্বন্ধে আমার অজ্ঞতা দূর করিয়া তিনি আমার পরম ধন্যবাদের পাত্র হইয়াছেন। আর ‘স্কুল পালানে ছেলেরাই কবি হয়’ সুকবি হইবার এই সুন্দর সংকেতটি বলিয়া দিয়া তিনি জগৎশুদ্ধ লোককে উপকৃত করিয়াছেন। লেখক আমাদের আধুনিক অবস্থার যে জীবন্ত চিত্র আঁকিয়াছেন। আমি কিংবা আর কেহ যে তাহার কোনো অংশ সংশোধন করিয়া দিতে পারে এমন বোধ হয় না। তবে কি না। আমার জ্ঞানস্পহাটা বড়োই বলবতী, তাহারি উত্তেজনায় আমি আরও কিছু শিক্ষা লাভের জন্যে লালায়িত, তাই গুটিকতক কথা না বলিয়া থাকিতে পারিতেছি না। এই কথাগুলিতে যদি আমার অত্যন্ত অসাধারণ অজ্ঞতা বা নিবুদ্ধিতা প্ৰকাশ পায়। তদুষ্ট লেখক আমার প্রতি ঘূণার পরিবর্তে যেন কৃপাদৃষ্টিপাত করেন এইমাত্র প্রার্থনা। আমাদের দেশীয় লোকদের স্বভাবতই ব্যায়ামে বিরাগ ও ইয়ুরোপীয়দের তাহাতে অনুরাগ এ সম্বন্ধে লেখকেতে আমাতে কখনোই মতভেদ ছিল না। ইয়ুরোপীয়ানদের সহিত সেই প্ৰভেদ ঘুচাইবার জন্যে, আমাদের যে মদ মাংস খাইতেই হইবে, এমন কোনো কথা আমি কি না কোনোখানেই বলি নাই, অতএব লেখক ওই কথাটার উপরে যেরূপ আক্রোশ প্ৰকাশ করিয়াছেন এবং মাংস খাওয়া এ দেশীয় লোকের সাধ্যায়ত্ত কি না, ইয়ুরোপীয়দের খাদ্য আমাদের দেশে খাটে কি না খাটে এই সমস্ত বিষয় লইয়া তিনি যেরূপ ভাবিত হইয়া উঠিয়াছেন তদারা এই অল্প বয়সে। তঁহার এতাদৃশ দূরদৃষ্টির পরিচয় পাইয়া পরম গ্ৰীত হইলাম। লেখক বলিয়াছেন, “আমাদের ব্যায়াম চৰ্চা কর্তব্য বোধে করিতে হইবে।” আমিও তো তােহাঁই বলিতেছি। "ছাত্রেরা যে খেলাধূলা আমোদপ্রমোদ ভুলিয়া ঘরে বসিয়া বিদেশী ব্যাকরণের শুষ্ক সূত্র, বীজগণিতের কঠিন আঁটি ও জ্যামিতির তীক্ষু ত্রিকোণ চতুষ্কোণ গিলিতে থাকে তাহার অবশ্যই একটা কারণ আছে। সে কারণটি কী? তাহারা যে “বীজগণিতের প্রেমে পড়িয়া এরূপ করে না' তাহা লেখক নিজেই স্বীকার করিয়াছেন। আমার তো বোধ হয় তাহার কারণ এই যে, ছাত্রদের বিশ্বাস যে, এই কষ্টগুলি ভোগ করিলে ইহা অপেক্ষা গুরুতর কতকগুলি কষ্টের হাত এড়াইতে সক্ষম হইবার পক্ষে খুবই সম্ভাবনা আছে। এই বিশ্বাসের জোরেই তাহারা “বিদেশী চালকড়াই ভাজা দন্তহীন মাড়ি দিয়া চিবাইতে" এবং ‘বীজগণিতের কঠিন আঁটি গিলিতে’ চেষ্টা পায় ও তাঁহাতে কৃতকাৰ্যও হয়। বিদ্যা-শেখা-না-শেখার ফলাফল তাঁহাদের যেরূপ হৃদয়ংগম হইয়াছে এবং ওই বিশ্বাসটি তাঁহাদের হৃদয়ে যেরূপ বদ্ধমূল হইয়াছে সেইরূপ, স্বাস্থ্যের নিয়ম সকল পালন না করিলে শরীর যথোচিতরূপে বর্ধিত হয় না, অসম্পূৰ্ণ শরীরে মানসিক বৃত্তি সকলের যথোচিত স্মৃর্তি কখনোই হইতে পারে না, শরীর ও মন এ দুইই যথোচিতরূপে বৰ্ধিত এবং সুস্থ ও বলিষ্ঠ না থাকিলে এ পৃথিবীতে কোনো কাজই সুসিদ্ধ হয় না, কোনো স্থায়ী উন্নতি লাভ করা যায় না- এইগুলি যদি তাহদের হৃদয়ংগম হয়। আর, শরীর ও মনের শুভাশুভ যে অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা, এই বিশ্বাসটি তাহদের হৃদয়ে সেইরূপ বদ্ধমূল হয়, তাহা হইলে যেমন নীরসতা সত্ত্বেও তাহারা ‘বীজগণিতের আঁটি গেলেন।” তেমনি ব্যায়ামে বিরাগ সত্ত্বেও তাহার উপকারিতাবোধে তাহারা তাহা করিবেন। যখন কর্তব্যবোধে একটা কাজ করিয়া আসিতেছেন তখন কর্তব্যবোধে আর-একটা কাজ কেনই বা না করিতে পরিবেন, বিশেষত দুই কর্তব্যেরই যখন সমান গুরুত্ব ? দুই কর্তব্যই বা কেন বলিতেছি, যখন শরীর সুস্থ না রাখিলে মন সুস্থ রাখা যাইতে পারে না, তখন মনের প্রতি কর্তব্য আর শরীরের প্রতি কর্তব্য দুইই তো একই কর্তব্যের সামিল হইল। ছাত্রদের শরীরের প্রতি তাচ্ছিল্য দেখিয়া মনে হয় যে, শরীর, মনের নিকটসম্বন্ধ