পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Abr. রবীন্দ্র-রচনাবলী এখনও তাঁহাদের তাদৃশ হৃদয়ংগম হয় নাই। কিন্তু লেখক একস্থানে বলিয়াছেন যে "ছাত্রদের বুঝিতে বাকি নাই যে ব্যায়াম চর্চায় শরীর সুস্থ হয়।” তবে বোধ হয় তাহা জানিয়াও, ছাকড়া গাড়ির কর্তারা তাহদের ঘোড়াকে যেরূপ ভাবে দেখে ছাত্রেরাও তাহদের শরীরটাকে সেই ভাবে দেখোন- যত কম সেবায় যত অল্পদিনের মধ্যে যত বেশি কাজ দিতে পারে ততই ভালো। যত শীঘ্র যে-কোনো প্রকারে হউক চোখে-মুখে খানিকটা বিদ্যা গুজিয়া পাসটা দিয়া একটা দশ-কুড়ি টাকার চাকরি জেটাইতে পারিলে হয়। বস, তাহা হইলেই পার্থিব সুখের একেবারে চূড়ান্ত সীমা হইল! হইল কি ? না পাসটা হইলেই চাকরিটা হইবে এই বিশ্বাসের উপর তাহার দু-একটি ছেলেমেয়েও হইয়াছে। বালকের সেই বড়ো দুঃখের দশ-কুড়ি টাকার চাকরিটি হস্তগত হইতে-না-হইতেই তাহার মস্তকের উপরে সংসারের বোঝা চারি দিক হইতে চাপিয়া পড়িল। তিনি তখন 'হা অন্ন, হা। অন্ন” করিয়া নিজেও ঝালাপালা হইতে লাগিলেন আর তাহার অপেক্ষাকৃত সচ্ছল অবস্থাপন্ন আখীয়-বস্কৃদিগকেও ঝালাপালা করিয়া তুলিলেন। ছ্যাকড়া গাড়ির ঘোড়ার শরীরের প্রতি যে অত্যাচার হয় তাহার ফল কেবলমাত্র সেই ঘোড়াতেই ফলে আর তাঁহাতেই শেষ হয়। কিন্তু বালকের শরীরের প্রতি যে অত্যাচার হয় তাহার ফল পুরুভুজের ন্যায় বালকের প্রত্যেক শাখা-প্ৰশাখায় জীবন্ত হইয়া উঠে। অসম্পূর্ণরূপে বর্ধিত ও অপক-শরীর বালকের সন্তান-সন্ততি কখনোই পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় না; সন্তানেরা ক্ষীণ কিংবা রুগণ শরীর লইয়াই জন্মগ্রহণ করে। তাহার পরে হয়তো যথাবশ্যক আহারাভাবে তাহদের শরীরের অবস্থা মন্দ হইতে মন্দতর হইতে থাকে। এইরূপে মরিয়া বঁচিয়া কোনোপ্রকারে মানুষ হইতে থাকে। আবার পাছে বাপের বিপুল কষ্টরাশির কোনো অংশ হইতে সম্ভানটি বঞ্চিত হয় এই ভয়েই যেন বালক যত শীঘ্র হয়, ছেলের লেখাপড়া আরম্ভ করিয়া দেন, তাহকে ধমকাইয়া, মারিয়া, রাত জাগাইয়া পাসের জন্য প্রস্তুত করেন। এই অপূর্ণ, রুগণ, ভগ্ন শরীর লইয়া পািসটাস দিয়া ছেলে যদি বা আর কোনো কালে কখনো মাথা তুলিতে সক্ষম হয়, সে সম্ভাবনা যেন সম্পূর্ণরূপে দূর করিয়া দিবার জন্যেই পাস দিতে-না-দিতেই পিতা পুত্রের গলায় একটি বধু বাঁধিয়া দেন। বালক যে হতভাগিনীর পাণিগ্রহণ করিয়াছেন স্বামীর দুঃখে, সন্তানের কষ্টে তাহার তো একদিনের তরেও চোখের জল শুকায় না। এইরূপে দেখা যাইতেছে যে, বালকের শরীরের প্রতি অত্যাচারের ফল শুদ্ধ একজনে বা এক পুরুষে শেষ হয় না, ক্রমিকই বিস্তৃত হইতে ও বৃদ্ধি পাইতে থাকে। বাঙালি বালকের জীবনের এখন এই তিনটি কাজ হইয়াছে- জন্ম, পাস, মৃত্যু। জীবনের সমস্ত কাজ সারিয়া ফেলিবার এতই যদি তাড়াতাড়ি পড়িয়া থাকে তাহা হইলে গুষ্টিশুদ্ধ দন্ধে দন্ধে মরা কেন, জন্মের পরেই মৃত্যুটাকে আনিলেই তো সব ল্যাঠা একেবারে চুকিয়া যায়- সব জ্বালা-যন্ত্রণার হাত চট করিয়া চিরকালের মতো এড়ানো যায়। একটা একজামিন পাস করিয়া যৎকথঞ্চিৎ গ্রাসাচ্ছাদনের জোগাড় করিতে পারিলেই কি মনুষ্যজীবনের সার্থকতা সম্পাদন হইল? আমরা কি কেবল একজামিন পাস করিতেই জন্মগ্রহণ করিয়াছি। মনুষ্যজীবনের কি উহা অপেক্ষা উচ্চ আশা, মহৎ উদ্দেশ্য আর কিছুই নাই ? সত্য বটে প্রাসাচ্ছাদনের সংস্থান সর্বাগ্রে প্রয়োজন, কিন্তু তাহাঁই বা সুসম্পন্ন হইতেছে কোথায়? আর, ওই কাৰ্যসিদ্ধির নিমিত্তে যে উপায় অবলম্বন করা হইতেছে সে যে আত্মঘাতী উপায়! ছেলের অল্পবন্ত্রের উপায় করিতে গিয়া, যে-শরীরকে সে অন্ন পোষণ করিবে, যে-শরীরকে সে বস্ত্ৰ আবৃত করিবে সেই শরীরকেই যে ক্ষয় করিয়া ফেলা হইতেছে। ছেলের প্রাণ বাঁচাইতে গিয়া তাহাকে যে অতি দ্রুতপদে মরণের পথে অগ্রসর করিয়া দিতেছ। বিদ্যাশিক্ষাদ্বারা ছেলের বুদ্ধিবৃত্তি বৃদ্ধি হইবে বলিয়া শীঘ্র শীঘ্ৰ তাহার মাথার ভিতরে বিদ্যা ঠাসিয়া ঠাসিয়া সেই বুদ্ধিবৃত্তির ভিত্তিভূমিকেই যে একেবারে চাপিয়া পিথিয়া চূৰ্ণ করিয়া দিতেছ। এ যে গোড়া কাটিয়া আগায় জল ঢালা।ইহা দেখিয়া, জানিয়া বুৰিয়া তবুও কি ইহার প্রতিকারের কোনো উপায় অবলম্বন