পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় ՊծՇ করিবে না? আমাদের অবস্থা মন্দ হইয়াছে বলিয়া কি মন্দকেই আমাদের অঙ্গের আভরণের মতো করিয়া দেখিব ? আমাদের আশা-ভরসা, আকাঙ্ক্ষা, উদ্দেশ্যকে একেবারে গণ্ডিবদ্ধ করিয়া রাখিব, গণ্ডির বাহিরে দৃকপাতও করিতে দিব না? আমরা তো আর উদ্ভিদ হইয়া জন্মাই নি যে, যে-অবস্থায় জন্মিয়াছি সেইখানে মাটি কামড়াইয়া পড়িয়া থাকিতেই হইবে। লেখক ব্যায়ামের উপকারিতা স্বীকার করিয়া তাহার একটি বাধা দেখাইয়াছেন- সময়ের অভাব। সময়াভাবের দুইটি কারণ দিয়াছেন : ১ম, দরিদ্রতা, ২য়, দুর্জেয় বিদেশী ভাষা অল্প সময়ের মধ্যে আয়ত্ত করিবার আবশ্যকতা। প্ৰথম বাধার সম্বন্ধে আমার যাহা বক্তব্য তাহাঁই প্ৰথমে বলি, ব্যায়ামের অর্থ - শারীরিক পরিশ্রম। আমরা সচরাচর, যো-পরিশ্রম আমরা শখ করিয়া করি তাহাকে বলি ব্যায়াম। পরিশ্রমের কাজ এই যে, সমস্ত শরীরটা খানিকটা নাড়াচড়া পাওয়াতে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে বেশ ভালোরাপে। রক্ত চলাচল হয় এবং সেইজন্যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি যথোচিত পুষ্ট ও বলিষ্ঠ হইতে পারে। যে “দরিদ্র বালকদের ভাতে নুন জোটে না” তাহদের যে দুই বেলা হাঁটিয়া স্কুলে যাতায়াত করিতে হয় এ-বিষয়ে বোধ করি। কাহারো কিছু মাত্ৰ সন্দেহ থাকিতে পারে না, তদব্যতীত তাহদের অনেক সময় বাজারে যাইতে হয় ও নানাবিধ কাজকর্ম উপলক্ষে নানা স্থানে আনাগোনা করিতে হয়। দরিদ্র বালকদের দায়ে পড়িয়া হয়তো এত পরিশ্রম করিতে হয় যে, তাহদের পক্ষে ‘ব্যায়ামের” অপেক্ষা বিরামের’ উপদেশ অধিক উপযোগী । ২য় বাধা- দুর্জেয় বিদেশী ভাষা অল্প সময়ের মধ্যে আয়ত্ত করিবার আবশ্যকতা হেতু সময়াভাব। ৯টা-১০টা বেলায় ছেলেরা স্কুলে যায়, তিন-চারিটার সময় বাড়ি আসে। ইহাতে তাহাদের প্রত্যুষে এক ঘণ্টা কাল ও সন্ধ্যার পূর্বে এক ঘণ্টা কাল ব্যায়ামের আমি তো কোনো বাধা দেখিতে পাই না। সমস্তক্ষণ স্কুলে পড়িয়া শ্ৰাম্ভ মস্তিষ্কে, পথের রৌদ্রের তাপে শীর্ণ শরীরে বিকালে বাড়ি আসিয়াই তখনই আবার পড়িতে বসিলে স্বাস্থ্যের তো হানি হয়ই, তদব্যতীত শরীর মনের দুর্বলতা প্ৰযুক্ত তৎকালে পাঠাভ্যাস অন্য সময় অপেক্ষা অধিক আয়াসীসাধ্য হইয়া উঠে। স্কুল হইতে আসিবার পর খানিকটা ব্যায়াম দ্বারা শরীর-মন বেশ তাজা হইয়া উঠিলে তখন আবার পাঠাভ্যাসে প্ৰবৃত্ত হইলে সকল দিকেই মঙ্গল। আমাদের বিদেশী ভাষায় জ্ঞান উপার্জন করিতে হয় ইহা বড়োই কষ্টকর, এ কষ্ট আমি লেখকের সহিত ঠিক সমানভাবে অনুভব করিতেছি। আমাদের পূর্বপুরুষদিগের কর্মফলস্বরূপ এই কষ্ট আমরা ভোগ করিতেছি। কিন্তু আমাদের এই একটা অসুবিধা ঘটিয়াছে, তাই একটা কষ্টভোগ করিতে হইতেছে বলিয়া সেই দুঃখে গা ঢালিয়া দিয়া শারীরিক, মানসিক উন্নতির আর সকল প্রকার উপায়ের প্রতি কি আমরা অন্ধ হইয়া থাকিব এবং এইরূপে আরও পাঁচ রকম অসুবিধা, আরও পাঁচটা কষ্ট আপনাদের উপর চাপাইব ? ইংরাজেরা আমাদের দেশ জয় করিয়া বলপূর্বক তাহাদের ভাষা এ-দেশে প্রচলিত করিয়াছে, সেই অভিমানে আত্মহত্যা করিয়া আমরা কি তাহার শোধ তুলিতে উদ্যত হইয়াছি ? না ইংরাজদের উপর আড়ি করিয়া শরীর-মন এমন ক্ষীণ করিয়া ফেলিতে হইবে যে আর কোনোকালে তাহদের দাসত্বশৃঙ্খল ছিড়িবার কোনো সম্ভাবনা না থাকে? জ্বর হইয়াছে বলিয়া কি ঔষধ-পথ্যের প্রতি তাচ্ছিল্য করিয়া বিকার পর্যন্ত টানিয়া আনিতে হইবে ? এই কি উচিত ? কষ্ট নিবারণের যথাসাধ্য চেষ্টা না করিয়া কেবল যদি খেদ করিয়াই কাল কাঁটাই, তাহা হইলে এই সমস্ত কষ্টের বোঝা আমাদের সন্তান-সন্ততির মাথায় চাপাইয়া আমরা কি পাপের ভাগী হইব না ? এখন তোমাদের- বালকদের উপরেই সমস্ত নির্ভর করিতেছে। তোমরাই আমাদের একমাত্র আশা-ভরসার স্থল। তোমরা বিদেশীদের জ্ঞানসকল সুন্দরীরূপে পরিপাক করিয়া স্বদেশীয় রক্তমাংসে পরিণত করো। নানা ভাবা হইতে নানা রত্নরাজি আহরণ করিয়া দুঃখিনী মাতৃভাষার অভাবসকল শীঘ্ৰ দূর করো। তাহা হইলে বিদেশীয় ভাষায় বিদ্যা উপার্জনের কষ্ট