পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চার অধ্যায় ভূমিকা এলার মনে পড়ে তার জীবনের প্রথম সূচনা বিদ্রোহের মধ্যে। তার মা মায়াময়ীর ছিল বাতিকের ধাত, তার ব্যবহারটা বিচার-বিবেচনার প্রশস্ত পথ ধরে চলতে পারত না । বেহিসাবি মেজাজের অসংযত ঝাপটায় সংসারকে তিনি যখন-তখন ক্ষুব্ধ করে তুলতেন, শাসন করতেন অনায় করে, সন্দেহ করতেন অকারণে । মেয়ে যখন অপরাধ অস্বীকার করত, ফস করে বলতেন, মিথ্যে কথা বলছিস । অথচ অবিমিশ্র সত্যকথা বলা মেয়ের একটা ব্যাসন বললেই হয়। এজন্যেই সে শাস্তি পেয়েছে সব-চেয়ে বেশি। সকল রকম অবিচারের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণুতা তার স্বভাবে প্রবল হয়ে উঠেছে । তার মার কাছে মনে হয়েছে, এইটেই স্ত্রীধর্মনীতির বিরুদ্ধ । একটা কথা সে বাল্যকাল থেকে বুঝেছে যে, দুর্বলতা অত্যাচারের প্রধান বাহন। ওদের পরিবারে যে-সকল আশ্ৰিত অন্নজীবী ছিল, যারা পরের অনুগ্রহ-নিগ্রহের সংকীর্ণ বেড়া-দেওয়া ক্ষেত্রের মধ্যে নিঃসহায়ভাবে আবদ্ধ তারাই কলুষিত করেছে। ওদের পরিবারের আবহাওয়াকে, তারাই ওর মায়ের অন্ধ প্রভুত্বচর্চাকে বাধাবিহীন করে তুলেছে। এই অস্বাস্থ্যকর অবস্থার প্রতিক্রিয়ারূপেই ওর মনে অল্পবয়স থেকেই স্বাধীনতার আকাঙক্ষা এত দুর্দাম হয়ে উঠেছিল। এলার বাপ নরেশ দাসগুপ্ত সাইকলজিতে বিলিতি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন । তীক্ষ্ম তার বৈজ্ঞানিক বিচারশক্তি, অধ্যাপনায় তিনি বিশেষভাবে যশস্বী। প্রাদেশিক প্রাইভেট কলেজে তিনি স্থান নিয়েছেন যেহেতু সেই প্রদেশে তার জন্ম, সাংসারিক উন্নতির দিকে তীর লোভ কম, সে-সম্বন্ধে দক্ষতাও সামান্য । ভুল করে লোককে বিশ্বাস করা ও বিশ্বাস করে নিজের ক্ষতি করা বার বারকার অভিজ্ঞতাতেও তীর শোধন হয় নি। ঠকিয়ে কিংবা অনায়াসে যারা উপকার আদায় করে তাদের কৃতঘ্নতা সব-চেয়ে অকরুণ। যখন সেটা প্রকাশ পেত। সেটাকে মনস্তত্ত্বের বিশেষ তথ্য বলে মানুষটি অনায়াসে স্বীকার করে নিতেন, মনে বা মুখে নালিশ করতেন না | বিষয়বুদ্ধির ত্রুটি নিয়ে স্ত্রীর কাছে কখনো তিনি ক্ষমা পান নি, খোটা খেয়েছেন প্রতিদিন । নালিশের কারণ অতীতকালবতী হলেও তার স্ত্রী কখনো ভুলতে পারতেন না, যখন-তখন তীক্ষ খোচায় উসকিয়ে দিয়ে তার দাহকে ঠাণ্ডা হতে দেওয়া অসাধ্য করে তুলতেন । বিশ্বাসপরায়ণ ঔদার্যগুণেই তার ব্যাপকে কেবলই ঠকতে ও দুঃখ পেতে দেখে বাপের উপর এলার ছিল সদাব্যথিত স্নেহ— যেমন সকরুণ স্নেহ মায়ের থাকে অবুঝ বালকের 'পরে । সাব-চেয়ে তাকে আঘাত করত যখন মায়ের কলহের ভাষায় তীব্ৰ ইঙ্গিত থাকত যে, বুদ্ধিবিবেচনায় তিনি তার স্বামীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ | এলা নানা উপলক্ষে মায়ের কাছে তার বাবার অসম্মান দেখতে পেয়েছে, তা নিয়ে নিম্বফল আক্ৰোশে চোখের জলে রাত্রে তার বালিশ গেছে ভিজে | এরকম সুন্টু ধৈর্য শুনায় বলে এল অনেক সময় তার বাবাকে মেন মনে অপরধী না করে থাকতে পারে নি । ” অত্যন্ত পীড়িত হয়ে একদিন এলা বাবাকে বলেছিল, “এরকম অন্যায় চুপ করে সহ্য করাই অন্যায় ।” নরেশ বললেন, “স্বভাবের প্রতিবাদ করাও যা আর তপ্ত লোেহায় হাত বুলিয়ে তাকে ঠাণ্ডা করতে যাওয়াও তাই, তাতে বীরত্ব থাকতে পারে। কিন্তু আরাম নেই ।”