পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

w©ዒbr রবীন্দ্র-রচনাবলী “চুপ করে থাকাতে আরাম আরো কম”— বলে এলা দ্রুত চলে গেল। এদিকে সংসারে এলা দেখতে পায়, যারা মায়ের মন জুগিয়ে চলবার কৌশল জানে তাদের চক্রান্তে নিষ্ঠুর অন্যায় ঘটে। অপরাধহীনের প্রতি । এল সইতে পারে না, উত্তেজিত হয়ে সত্য প্রমাণ উপস্থিত করে বিচারকত্রীর সামনে । কিন্তু কর্তৃত্বের অহমিকার কাছে অকাট্য যুক্তিই দুঃসহ স্পর্ধা। অনুকুল ঝোড়ো হাওয়ার মতো তাতে বিচারের নীেকো এগিয়ে দেয় না, নীেকো দেয় কাত করে। এই পরিবারে আরো একটি উপসর্গ ছিল যা এলার মনকে নিয়ত আঘাত করেছে । সে তার মায়ের শুচিবায়ু । একদিন কোনো মুসলমান অভ্যাগতকে বসবার জন্যে এলা মাদুর পেতে দিয়েছিল- সে মাদুর মা ফেলে দিলেন, গালচে দিলে দোষ হত না। এলার তার্কিক মন, তর্ক না করে থাকতে পারে না । বাবাকে একদিন জিজ্ঞাসা করলে, “আচ্ছা এই-সব ছোয়াছুয়ি নাওয়াখাওয়া নিয়ে কটকেন। মেয়েদেরই কেন এত পেয়ে বসে ? এতে হৃদয়ের তো স্থান নেই, বরং বিরুদ্ধতা আছে ; এ তো কেবল যন্ত্রের মতো অন্ধভাবে মেনে চলা ।” সাইকলজিস্ট বাবা বললেন, “মেয়েদের হাজার বছরের হাতকড়ি-লাগানো মন ; তারা মানবে, প্রশ্ন করবে না— এইটোতেই সমাজ-মনিবের কাছে বিকশিশ পেয়েছে, সেইজনে মানাটা যত বেশি অন্ধ হয় তার দাম তাদের কাছে তত বড়ো হয়ে ওঠে । মেয়েলি পুরুষদেরও এই দশা ।” আচারের নিরর্থকতা সম্বন্ধে এলা বার বার মাকে প্রশ্ন না করে থাকতে পারে নি, বার বার তার উত্তর পেয়েছে ভৎসনায় । নিয়ত এই ধাক্কায় এলার মন অবাধ্যতার দিকে ঝুকে ?t r নরেশ দেখলেন পারিবারিক এই-সব দ্বন্দ্বে মেয়ের শরীর খারাপ হয়ে উঠছে, সেটা তাকে অত্যন্ত বাজল । এমন সময় একদিন এলা একটা বিশেষ অবিচারে কঠোরভাবে আহত হয়ে নরেশের কাছে এসে জানােল, “বাবা, আমাকে কলকাতায় বাের্ডিঙে পাঠাও।” প্রস্তাবটা তাদের দুইজনের পক্ষেই দুঃখকর, কিন্তু বাপ অবস্থা বুঝলেন, এবং মায়াময়ীর দিক থেকে প্রতিকূল ঝঞাঘাতের মধ্যেও এলাকে পাঠিয়ে দিলেন দূরে । আপনি নিষ্কারুণ সংসারে নিমগ্ন হয়ে রইলেন অধ্যয়ন-অধ্যাপনায়। মা বললেন, “শহরে পাঠিয়ে মেয়েকে মেমসাহেব বানাতে চাও তো বানাও কিন্তু ঐ তোমার আদূরে মেয়েকে প্রাণান্ত ভুগতে হবে শ্বশুরঘর করবার দিনে | তখন আমাকে দোষ দিয়ে না।” মেয়ের ব্যবহারে কলিকালোচিত স্বাতন্ত্র্যের দুলক্ষণ দেখে এই আশঙ্কা তার মা বার বার প্রকাশ করেছেন । এলা তার ভাবী শাশুড়ির হাড় জ্বালাতন করবে। সেই সম্ভাবনা নিশ্চিত জেনে সেই কাল্পনিক গৃহিণীর প্রতি তার অনুকম্পা মুখর হয়ে উঠত । এর থেকে মেয়ের মনে ধারণা দৃঢ় হয়েছিল যে, বিয়ের জনো মেয়েদের প্রস্তুত হতে হয় আত্মসম্মানকে পঙ্গু করে, ন্যায়-অন্যায়বোধকে অসাড় করে দিয়ে ! এলা যখন ম্যাট্রিক পার হয়ে কলেজে প্রবেশ করেছে তখন মায়ের মৃত্যু হল। নরেশ মাঝে মাঝে বিয়ের প্রস্তাবে মেয়েকে রাজি করতে চেষ্টা করেছেন। এলা অপূর্ব সুন্দরী, পাত্রের তরফে প্রাথীর অভাব ছিল না, কিন্তু বিবাহের প্রতি বিমুখতা তার সংস্কারগত। মেয়ে পরীক্ষাগুলো পাস করলে, তাকে অবিবাহিত রেখেই বাপ গেলেন মারা । সুরেশ ছিল তার কনিষ্ঠ ভাই। নরেশ এই ভাইকে মানুষ করেছেন, শেষ পর্যন্ত পড়িয়েছেন খরচ দিয়ে । দু-বছরের মতো তাকে বিলেতে পাঠিয়ে স্ত্রীর কাছে লাঞ্ছিত এবং মহাজনের কাছে ঋণী হয়েছেন । সুরেশ এখন ডাকবিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারী। কর্ম উপলক্ষে ঘুরতে হয় নানা প্রদেশে । তারই উপর পড়ল এলার ভার। একান্ত যত্ন করেই ভার নিলেন । সুরেশের স্ত্রীর নাম মাধবী। তিনি যে-পরিবারের মেয়ে সে-পরিবারে স্ত্রীলোকদের পরিমিত পড়াশুনেই ছিল প্রচলিত ; তার পরিমাণ মাঝারি মাপের চেয়ে কম বৈ বেশি নয়। স্বামী বিলেত থেকে ফিরে এসে উচ্চপদ নিয়ে দূরে দূরে যখন ঘুরতেন তখন তাকে বাইরের নানা লোকের সঙ্গে সামাজিকতা করতে হত । কিছুদিন অভ্যাসের পরে মাধবী নিমন্ত্রণ-আমন্ত্রণে বিজাতীয় লৌকিকতা পালন করতে অভ্যস্ত হয়েছিলেন । এমন-কি, গোরাদের ক্লাবেও পঙ্গু, ইংরেজি ভাষাকে সকারণ ও অকারণ হাসির দ্বারা পূরণ করে কাজ চালিয়ে আসতে পারতেন।