পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VObrbro রবীন্দ্র-রচনাবলী “তা হলে ওকে তোমাদের মধ্যে রেখেছ কোন সাহসে ?” “কানাই, এতদিনে আমাকে তোমার বোঝা উচিত ছিল । আগুনকে যে ভয় করে সে আগুনকে ব্যবহার করতে পারে না | আমার কাজে আমি আগুনকে বাদ দিতে চাই নে ৷” “অর্থাৎ তাতে কাজ নষ্ট হােক বা না হােক, তুমি কেয়ার কর না ।” “সৃষ্টিকর্তা আগুন নিয়ে খেলা করে। নিশ্চিত ফলের হিসেব করে সৃষ্টির কাজ চলে না ; অনিশ্চিতের প্রত্যাশাতেই তার বিরাট প্রবর্তন । ঠাণ্ডা মালমসলা নিয়ে বুড়ো আঙুলে টিপে টিপে যে পুতুল গড়া হয় তার বাজারদার খতিয়ে লোভ করবার মন আমার নয়। ঐ যে অতীন ছেলেটা এসেছে এলার টানে, ওর মধ্যে বিপদ ঘটাবার ডাইনামাইট আছে- ওর প্রতি তাই আমার এত ঔৎসুক। " “ভায়া, তোমার এই ভীষণ ল্যাবরেটরিতে আমরা ঝাড়ন কাধে বেহারিার কাজ করি মাত্র | খেপে ওঠে যদি কোনো গ্যাস, যদি কোনো যন্ত্র ফেটে ফুটে ছিটকে পড়ে তা হলে আমাদের কপাল ভাঙবে সাতখানা হয়ে । সেটা নিয়ে গর্ব করবার মতো জোর আমাদের খুলির তলায় নেই।” “জবাব দিয়ে বিদায় নেও না কেন ?” “ফলের লোভ যে আছে আমাদের, তোমার না থাকতে পারে । তোমারই দালালদের মুখে একদা শুনেছিলুম। Elixir of life হয়তো মিলতে পারে | তোমার এই সর্বনেশে রিসার্চের চক্রান্তে গরিব আমরা ধরা দিয়েছি নিশ্চিত আশারই টানে, অনিশ্চিতের কুহিকে নয় । তুমি এটাকে দেখছি জুয়োখেলার দিক থেকে, আমরা দেখছি ব্যাবসার সাদা চোখে । অবশেষে খন্তেনের খাতায় আগুন লাগিয়ে আমাদের সঙ্গে ঠাট্টা কোরো না ভায়া। ওর প্রত্যেক সিকি পয়সায় আছে আমাদের বুকের রক্ত ।” “আমার মনে কোনো অন্ধ বিশ্বাস নেই, কানাই । হারজিতের কথা ভাবা একেবারে ছেড়ে দিয়েছি । প্ৰকাণ্ড কর্মের ক্ষেত্রে আমি কর্তা, এইখানেই আমাকে মানায় বলেই আমি আছি- এখানে হারও বড়ো জিতও বড়ো । ওরা চার দিকের দরজা বন্ধ করে আমাকে ছোটাে করতে চেয়েছিল, মরতে মরতে প্রমাণ করতে চাই আমি বড়ো । আমার ডাক শুনে কত মানুষের মতো মানুষ মৃত্যুকে অবজ্ঞা করে চারি দিকে এসে জুটল ; সে তো তুমি দেখতে পােচ্ছ কানাই। কেন ? আমি ডাকতে পারি বলেই । সেই কথাটা ভালো করে জেনে এবং জানিয়ে যাব, তার পরে যা হয় হােক | তোমাকে তো বাইরে থেকে একদিন দেখতে ছিল সামান্য কিন্তু তোমার অসামান্যকে আমি প্রকাশিত করেছি। রসিয়ে তুললুম তোমাদের, মানুষ নিয়ে এই আমার রসায়নের সাধনা। আর বেশি কী চাই ? ঐতিহাসিক মহাকাব্যের সমাপ্তি হতে পারে পরাজয়ের মহাশ্মশানে । কিন্তু মহাকাব্য তো বটে । গোলামি-চাপা এই খর্ব মনুষ্যত্বের দেশে মরার মতো মরতে পারাও যে একটা সুযোগ ।” “ভায়া, আমার মতো অকাল্পনিক প্রাকটিকাল লোককেও তুমি টান মেরে এনেছ ঘোরতর পাগলামির তাণ্ডব নৃত্যমঞ্চে ! ভাবি যখন, এ রহস্যের অন্ত পাই নে আমি।” * “আমি কাঙালের মতো করে কিছুই চাই নে বলেই তোমাদের পরে আমার এত জোর । মায়া দিয়ে ভুলিয়ে লোভ দেখিয়ে ডাকি নে কাউকে । ডাক দিই অসাধ্যের মধ্যে, ফলের জন্যে নয়, বীর্য প্রমাণের জন্যে । আমার স্বভাবটা ইম্পর্সেনাল। যা অনিবাৰ্য তাকে আমি অক্ষুব্ধমনে স্বীকার করে নিতে পারি। ইতিহাস তো পড়েছি, দেখেছি কত মহা মহা সাম্রাজ্য গৌরবের অভ্ৰভেদীশিখরে উঠেছিল। আজ তারা ধুলোয় মিলিয়ে গেছে- তাদের হিসাবের খাতায় কোথায় মস্ত একটা দেনা জমে উঠেছিল যা তারা শোধ করে নি। আর এই দেশ যেহেতু এ আমারই দেশ, সৌভাগ্যের চিরস্বত্ব নিয়ে ইতিহাসের উচু গদিতে গদিয়ান হয়ে বসে থাকবে পরাভবের সমস্ত কারণগুলোর পায়ে সিঁদুরচন্দন মাখিয়ে ঘণ্টা নেড়ে পুজো করতে করতে, বোকার মতো এমন আবদার করব কার কাছে ? আমি তা কখনোই করি নে। বৈজ্ঞানিকের নিমোহ মন নিয়ে মেনে নিই যার মরণব্দশা সে মরবেই।” “তবে ।” “তবে ! দেশের চরম দুরবস্থা আমার মাথা হেঁট করতে পারবে না, আমি তারও অনেক উর্ধের্বআত্মার অবসাদ ঘটতে দেব না মরবার সমস্ত লক্ষণ দেখেও ।”