পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ᏔbᏱbr রবীন্দ্র-রচনাবলী স্থান-সংকোচে দুঃখ পাবে না।” অত্যন্ত ব্যথার জায়গায় যেন ঘা লাগল, জ্বলে উঠল। অতীনের দুই চোখ। পায়চারি করে এল ঘরের এধার থেকে ওধারে । তার পরে এলার সামনে এসে দাড়িয়ে বললে, “তোমাকে শক্ত কথা বলবার সময় এসেছে। জিজ্ঞাসা করি, দেশের কাছে হােক যার কাছেই হােক তুমি আমাকে সঁপে দেবার কে ? তুমি সঁপে দিতে পারতে মাধুর্যের দান, যা তোমার যথার্থ আপনি সামগ্ৰী।। তাকে সেবা বলে তো তাই বলো, বরদান বলো যদি তাও বলতে পাের ; অহংকার করতে যদি দাও তো করব অহংকার, নম্র হয়ে যদি আসতে বল দ্বারে তবে তাও আসতে পারি। কিন্তু তোমার আপনি দানের অধিকারকে আজ দেখছি তুমি ছোটাে করে। নারীর মহিমায় অন্তরের ঐশ্বৰ্য যা তুমি দিতে পারতে, তা সরিয়ে নিয়ে তুমি বলছ— দেশকে দিলে আমার হাতে। পার না দিতে, পার না, কেউ পারে না। দেশ নিয়ে এক হাত থেকে আর-এক হাতে নাড়ােনাড়ি চলে না ।” বিবর্ণ হয়ে এল এলার মুখ । বললে, “কী বলছি, ভালো বুঝতে পারছি নে ৷” “আমি বলছি নারীকে কেন্দ্র করে যে-মাধুর্যলোক বিস্তৃত, তার প্রসার যদি-বা দেখতে হয় ছােটাে, অন্তরে তার গভীরতার সীমা নেই- সে খাচা নয় । কিন্তু দেশ উপাধি দিয়ে যার মধ্যে আমার বাসা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলে তোমাদের দলের বানানো দেশে— অন্যের পক্ষে যাই হােক আমার স্বভাবের পক্ষে সেই তো খাচা । আমার আপনি শক্তি তার মধ্যে সম্পূর্ণ প্রকাশ পায় না বলেই অসুস্থ হয়ে পড়ে, বিকৃতি ঘটে তার, যা তার যথার্থ আপন নয় তাকেই ব্যক্ত করতে গিয়ে পাগলামি করে, লজ্জা পাই, অথচ বেরোবার দরজা বন্ধ | জান না, আমার ডানা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে, দুই পায়ে আঁট হয়ে লেগেছে বেড়ি । আপন দেশে আপনি স্থান নেবার দায় ছিল আপন শক্তিতেই, সে শক্তি আমার ছিল । কেন তুমি আমাকে সে কথা ভুলিয়ে দিলে ?” ক্লিষ্টকণ্ঠে এলা বললে, “তুমি ভুললে কেন, অন্তু ?” “ভোলাবার শক্তি তোমাদের অমোঘ, নইলে ভুলেছি বলে লজ্জা করতুম | আমি হাজারবার করে মানব যে, তুমি আমাকে ভোলাতে পাের, যদি না ভুলতুম, সন্দেহ করতুম আমার পৌরুষকে ৷” “তই যদি হয় তবে আমাকে ভৎসনা করছি কেন ?” “কেন ? সেই কথাটাই বলছি। ভুলিয়ে তুমি সেইখানেই নিয়ে যাও যেখানে তোমার আপনি বিশ্ব, আপন অধিকার | দলের লোকের কথার প্রতিধ্বনি করে বললে, জগতে একটিমাত্র কর্তব্যের পথ বেঁধে দিয়েছ তোমরা কজনে । তোমাদের সেই শানবাধানো সরকারি কর্তব্যপথে ঘুর খেয়ে কেবলই ঘুলিয়ে উঠছে আমার জীবনস্রোত ।” “ই, তোমাদের স্বদেশী কর্তব্যের জগন্নাথের রথ । মন্ত্রদাতা বললেন, সকলে মিলে একখানা মোটা দড়ি কাধে নিয়ে টানতে থাকো দুই চক্ষু বুজে— এই একমাত্র কাজ । হাজার হাজার ছেলে কোমর বেঁধে ধরল দড়ি। কত পড়ল। চাকার তলায়, কত হল চিরজন্মের মতো পঙ্গু। এমন সময় লাগল মন্ত্র উলটােরথের যাত্রায়। ফিরল রথ । যাদের হাড় ভেঙেছে তাদের হাড় জোড়া লাগবে না, পঙ্গুর দলকে বঁটিয়ে ফেললে পথের ধুলোর গাদায় । আপন শক্তির পরে বিশ্বাসকে গোড়াতেই এমনি করে ঘুচিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, সবাই সরকারি পুতুলের ছাচে নিজেকে ঢালাই করতে দিতে স্পর্ধা করেই রাজি হল । সর্দারের দড়ির টানে সবাই যখন একই নাচ নাচতে শুরু করলে, আশ্চর্য হয়ে ভাবলে- একেই বলে শক্তির নাচ । নাচনওয়ালা যেই একটু আলগা দেয়, বাতিল হয়ে যায় হাজার হাজার মানুষ-পুতুল ।” “অন্তু, ওদের অনেকেই যে পাগলামি করে পা ফেলতে লাগল, তাল রাখতে পারলে না ।” “গোড়াতেই জানা উচিত ছিল মানুষ বেশিক্ষণ পুতুল-নাচ নাচতে পারে না । মানুষের স্বভাবকে হয়তো সংস্কার করতে পাের, তাতে সময় লাগে। স্বভাবকে মেরে ফেলে মানুষকে পুতুল বানালে কাজ সহজ হয় মনে করা ভুল। মানুষকে আত্মশক্তির বৈচিত্ৰ্যবান জীব মনে করলেই সত্য মনে করা হয় ।