পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চার অধ্যায় \SS আমাকে সেই জীব বলে শ্রদ্ধা যদি করতে তা হলে আমাকে দলে তোমার টানতে না, বুকে টানতে ” “অন্তু গোড়াতেই কেন আমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলে না ? কেন আমাকে অপরাধী করলে !" “সে তো তোমাকে বার বার বলেছি। তোমার সঙ্গে মিলতে চেয়েছিলুম। এইটে অত্যন্ত সহজ কথা। দুৰ্জয় সেই লোভ । প্রচলিত পথটা ছিল বন্ধ। মরিয়া হয়ে জীবন পণ করলুম। বাকা পথে । তুমি মুগ্ধ হলে । আজ জেনেছি। আমাকে মরতে হবে এই রাস্তায় । সেই মরাটা চুকে গেলে তুমি আমাকে দুহাত বাড়িয়ে ফিরে ডাকবে— ডাকবে তোমার শূন্য বুকের কাছে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত ।” “পায়ে পড়ি, আমন করে বোলো না ।” “বোকার মতো বলছি, রোমান্টিক শোনাচ্ছে। যেন দেহহীন বস্তুহীন পাওয়াকে পাওয়া বলে ! যেন তোমার সেদিনকার বিরহ আজকের দিনের প্রতিহত মিলনের এক কড়াও দাম শোধ করতে পারে !" “আজ তোমাকে কথায় পেয়েছে, অন্তু ।” “কী বলছি ! আজি পেয়েছে! চিরকাল পেয়েছে। যখন আমার বয়স অল্প, ভালো করে মুখ ফোটে নি, তখন সেই মীেনের অন্ধকারের ভিতর থেকে কথা ফুটে ফুটে উঠছিল, কত উপমা কত তুলনা কত অসংলগ্ন বাণী । বয়স হল, সাহিত্যলোকে প্রবেশ করলুম, দেখলুম ইতিহাসের পথে পথে রাজাসাম্রাজ্যের ভগ্নস্তৃপ, দেখলুম। বীরের রণসজ্জা পড়ে আছে ভেঙে, বিদীর্ণ জয়স্তম্ভের ফাটলে উঠেছে অশথগাছ ; বহু শতাব্দীর বহু প্ৰয়াস ধূলার স্তুপে স্তব্ধ । কালের সেই আবর্জনারাশির সর্বোচ্চ দেখলুম আটল বাণীর সিংহাসন | সেই সিংহাসনের পায়ের কাছে যুগযুগান্তরের তরঙ্গ পড়ছে লুটিয়ে লুটিয়ে । কতদিন কল্পনা করেছি। সেই সিংহাসনের সোনার স্তম্ভে অলংকার রচনা করবার ভার নিয়ে এসেছি আমিও ! তোমার অন্তু চিরদিন কথায়-পাওয়া মানুষ । তাকে কোনোদিন ঠিকমত চিনবে সে আশা আর রইল না— তাকে কি না ভরতি করে নিলে দলের শতরঞ্চ খেলায় বোড়ের মধ্যে !" এলা চৌকি থেকে নেমে পড়ে অতীনের পায়ের উপর মাথা রাখলে । অতীন তাকে টেনে তুলে পাশে বসালে । বললে, “তোমার এই ছিপছিপে দেহখানিকে কথা দিয়ে দিয়েই মনে মনে সাজিয়েছি, তুমি আমার সঞ্চারিণী পল্লবিনী লতা, তুমি আমার সুখমতি বা দুঃখমিতি বা । আমার চারিদিকে আছে অদৃশ্য আবরণ, বাণীর আবরণ, সাহিত্যের অমরাবতী থেকে নেমে এসে ভিড় ঠেকিয়ে রাখে তারা । আমি চিরস্বতন্ত্র, সে-কথা জানেন তোমাদের মাস্টারমশায়, তবু আমাকে বিশ্বাস করেন কেন ?" “সেইজন্যেই বিশ্বাস করেন । সবার সঙ্গে মিলতে হলে সবার মধ্যে নাবিতে হয় তোমাকে । তুমি কিছুতেই নাবিতে পার না । তোমার পরে আমার বিশ্বাস সেইজনেই । কোনো মেয়ে কোনো পুরুষকে এত বিশ্বাস করতে পারে নি। তুমি যদি সাধারণ পুরুষ হতে তা হলে সাধারণ মেয়ের মতোই আমি তোমাকে ভয় করতুম | নিৰ্ভয় তোমার সঙ্গ ।” “ধিক সেই নিৰ্ভয়কে । ভয় করলেই পুরুষকে উপলব্ধি করতে। দেশের জন্যে দুঃসাহস দাবি কর, তোমার মতো মহীয়সীর জন্যে করবে না কেন ? কাপুরুষ আমি । অসম্মতির নিষেধ ভেদ করে কেন তোমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারি নি বহুপূর্বে যখন সময় হাতে ছিল ? ভদ্রতা ! ভালোবাসা তো বর্বর ! তার বর্বরতা পাথর ঠেলে পথ করবার জন্যে । পাগলাঝোরা সে, ভদ্রশহরেব পোষ-মানা কলের জল নয় ।” এলা দ্রুত উঠে পড়ে বললে, “চলো অন্তু, ঘরে চলো।” অতীন উঠে দাঁড়াল, বললে, “ভয় ! এতদিন পরে শুরু হল ভয় ! জিত হল আমার । যৌবন যখন প্রথম এসেছিল তখনো মেয়েদের চিনি নি। কল্পনায় তাদের দুৰ্গম দূরে রেখে দেখেছি ; প্রমাণ করবার সময় বলে গেল যে, তোমরা যা চাও তাই আমি। অন্তরে আমি পুরুষ, আমি বর্বর উদ্দাম । সময় যদি না হারাতুম এখনই তোমাকে বজুবন্ধনে চেপে ধরাতুম, তোমার পাজরের হাড় টনটন করে উঠত ; তোমাকে ভাববার সময় দিতুম না, কাদবার মতো নিশ্বাস তোমার বাকি থাকত না, নিষ্ঠুরের মতো টেনে