পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চার অধ্যায় 8O(? মুখ সে আজ যুগান্তরে পিিছয়ে গেছে। আজ সেই দিনটিকে আবাহন করা যাক এই পােড়ে ঘরটার মধ্যে | এসো, আরো কাছে ।” “বোসো, ঘরটা একটুখানি গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করি ।” “হায় রে, টাকের মাথায় চিরুনি চালাবার চেষ্টা ?” এলা একবার চারি দিক ঘুরে দেখলে । মেঝের উপর কম্বল, তার উপর চাটাই | বালিশের বদলে বুই দিয়ে ভরা একটা পুরানো ক্যাম্বিসের থলি । লেখাপড়া করবার জন্যে একখানা প্যাকবাক্স । কোণে জলের কলসি মাটির ভাড় দিয়ে ঢাকা । জীৰ্ণ চাঙারিতে একছড়া কলা, তার মধ্যে এনামেল উঠে-যাওয়া একখানা বাটি, দৈবাৎ সুযোগ ঘটলে চা খাওয়া চলে । ঘরের অন্য প্রান্তে একটা বড়ো চওড়া সিন্দুক, তার উপরে গণেশের একটি মাটির মূর্তি । তার থেকে প্রমাণ হয় এখানে অতীনের কোনো-এক দোসর আছে। এক থাম থেকে আর-এক থাম পর্যন্ত দড়ি খাটানো, তাতে নানা রঙের ঢুপ লাগা অনেকগুলো ময়লা গামছা | স্যাতসেতে ঘরে শ্বাসরুদ্ধ আকাশের বাষ্পঘন গন্ধ । ঠিক এমন না হােক এই জাতের দৃশ্য এলা দেখেছে মাঝে মাঝে । কখনো বিশেষ দুঃখ পায় নি, বরঞ্চ ত্যাগবীর ছেলেদেরকে মনে মনে বাহাদুরি দিয়েছে । একদা এক জঙ্গলের ধারে দেখেছিল অনিপুণ হাতে রান্নার চেষ্টায় পোড়ো চালের খড়-বাখারি জ্বালানো চুলোর ভস্মাবশেষ ; মনে হয়েছিল রাষ্ট্রবিপ্লবী রোমান্সের এ একটা অঙ্গারে-আঁকা ছবি । আজ কিন্তু কষ্টে ওর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল । আরামের বাহুবেষ্টনে ঘেরা ধনীর ছেলেকে অবজ্ঞা করাই এলার অভ্যস্ত | কিন্তু অতীনকে এই অপরিচ্ছন্ন মলিন অভাবজীৰ্ণ অকিঞ্চন তার মধ্যে কিছুতে ওর মন মিশ খাওয়াতে পারে না । এলার উদবিগ্ন মুখ দেখে অতীন হেসে উঠল, বললে, “আমার ঐশ্বর্য দেখছি স্তম্ভিত হয়ে, তার যে বিরাট অংশটা দেখা যাচ্ছে না, সেইটোতেই তুমি বিস্মিত । আমাদের পা খোলসা রাখতে হয়- দৌড় মরবার সময় মানুষও পিছু ডাকে না, জিনিসপত্রও না । কিছুদূরে পাটকলের মজুরদের বসতি, তারা আমাকে মাস্টারবাবু বলে ডাকে । চিঠি পড়িয়ে নেয়, ঠিকানা লিখিয়ে নেয়, বুঝিয়ে নেয় দেনাপাওনার রসদ ঠিক হল কি না । এদের কোনো কোনো সন্তানবৎসলাব শখ, ছেলেকে একদিন মজুরশ্রেণী থেকে হুজুর শ্রণীতে ওঠাবে। আমার সাহায্য চায়, ফলফুলুরি দেয় এনে, কারও বা ঘরে গোরু আছে দুধ জুগিয়ে থাকে ৷” "অস্তু, কোণে ঐ-যে সিন্দুক আছে। ওটা কার সম্পত্তি ?” ”অজায়গায় একলা থাকলেই বেশি করে চোখে পড়তে হয় । অলক্ষ্মীর বঁাটার মুখে রাস্তার থেকে এসে পড়েছে এই ঘরটাতে মাড়োয়ারি, তৃতীয় বাবকার দেউলে । আমার সন্দেহ হচ্ছে দেউলে হওয়াই ওর সর্বপ্রধান ব্যাবসা | এই পোড়ো দালানটা ওরা দুজন ভাইপোর ট্রেনিং অ্যাকাডেমি । তারা ভারবেলায় ছাতু খেয়ে কাজ করতে আসে, বসতির মেয়েদের জনো সস্তাদামের কাপড় রঙায়, বেচে মূলধনের সুদ দেয়, আসলেরও কিছু কিছু শোধ করে । ঐ যে মাটির গামলাগুলো দেখছ, ও আমি আমার যজ্ঞের রান্নায় ব্যবহার করি নে ; ওগুলোতে রঙ গোলা হয় । কাপড়গুলো তুলে রেখে যায় ঐ বাক্সের ভিতর, তা ছাড়া ওতে আছে বসতির মেয়েদের প্রসাধনযোগ্য নানা জিনিস— বেলোয়ারি চুড়ি, "চকনি, ছােটাে আয়না, পিতলের বাজু ; রক্ষা করবার ভার আমার উপর আর প্রেতাত্মার উপর। বেলা 'উনিটের সময় সওদা করতে বেরোয়, এখানে আর ফেরে না । কলকাতায় মাড়োয়ারি জানি নে কিসের “ললি করে । আমার ইংরেজি জানার লোভে আমাকে অংশীদার করতে চেয়েছিল, জীবের প্রতি দয়া *লৈ রাজি হয় নি। আমার আর্থিক অবস্থারও সন্ধান নেবার চেষ্টা ছিল, বুঝিয়ে দিয়েছি। পূর্বপুরুষের ধরে যা ছিল মজুত আজ তারই চােদে আনা ওদেরই পূর্বপুরুষের ঘরে জন্মান্তরিত।” "এখানে তোমার মেয়াদ কতদিনের ?” "আন্দাজ করছি চব্বিশ ঘণ্টা। ঐ আঙিনায় রসে-বিগলিত নানা রঙের লীলা সমানে চলবে দিনের পর দিন, অতীন্দ্র বিলীন হয়ে যাবে পাণ্ডুবৰ্ণ দূরদিগন্তে । আমার ছোয়াচ লেগেছে যে-মাড়োয়ারিকে তকৈ বেড়ি-পরা মহামারীতে না পায় এই আমি কামনা করি। এখনো বিনা মূলধনে আমার ভাগ্যভাগী