পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চার অধ্যায় 8の° “দেশ এর মধ্যে নেই অস্তু ?” “দেশের সাধনা আর তোমার সাধনা এক হয়েছে বলেই দেশ এর মধ্যে আছে। একদিন বীর্যের জোরে যোগ্যতা দেখিয়ে পেতে হত মেয়েকে । আজ সেই মরণপণের সুযোগ পেয়েছি। সে-কথাটা তুলে সামান্য আমার জীবিকার অভাব নিয়ে তোমার ব্যথা লেগেছে। অন্নপূর্ণা !" “আমরা মেয়েরা সাংসারিক । সংসারে অকুলোন সইতে পারি নে। আমার একটা কথা তোমাকে রাখতেই হবে। আমার আছে পৈতৃক বাড়ি, আরো আছে কিছু জমা টাকা । দোহাই তোমার, বার বার দোহাই দিচ্ছি, কথা রাখো, আমার কাছে টাকা নিতে সংকোচ কোরো না । জানি তোমার খুবই দরকার ।" “খুবই দরকার পড়লে ম্যাট্রিকুলেশনের নোটবই লেখা থেকে আরম্ভ করে কুলিগিরি পর্যন্ত খোলা রয়েছে ।” “আমি মানছি, অস্তু, আমার সমস্ত জমা টাকা দেশের কাজে এতদিনে খরচ করে ফেলা উচিত ছিল। কিন্তু উপার্জনে আমাদের সুযোগ কম বলেই সঞ্চয়ে আমাদের অন্ধ আসক্তি ৷ ভীতু আমরা ।” “ওটা তোমাদের সহজবুদ্ধির উপদেশ । নিঃসম্বলতায় মেয়েদের শ্ৰী নষ্ট হয় ।” “আমাদের ছোটাে নীড়, সেখানে টুকিটাকি কিছু আমরা জমা করি । কিন্তু সে তো কেবল বঁচবার প্রয়োজনে নয়, ভালোবাসার প্রয়োজনে | আমার যা-কিছু সমস্তই তোমার জন্যে এ-কথা যদি বুঝিয়ে দিতে পারি তা হলে বাচি ।” “কিছুতেই বুঝব না। ও-কথাটা । আজ পর্যন্ত মেয়েরা জুগিয়েছে সেবা, পুরুষরা জুগিয়েছে জীবিকা । তার বিপরীত ঘটলে মাথা হেঁট হয় | যে-চাওয়া নিয়ে অসংকোচে তোমার কাছে হাত পাততে পারি তাকে ঠেকিয়ে দিয়ে তুমি পণের বাধ বেঁধেছ। সেদিন নারায়ণী ইস্কুলের খাতা নিয়ে হিসেব মেলাচ্ছিলে। বসে পড়লুম কাছে, ঝড়ের ঘা খেয়ে চিল। যেমন ধুলায় পড়ে তেমনি | মার-খাওয়া মন নিয়ে এসেছিলুম। কর্তব্যের যেমন-তেমন একটা ছাপমারা জিনিসে মেয়েদের নিষ্ঠ পাণ্ডার পায়ে তাদের অটল ভক্তির মতোই, ছাড়িয়ে নেওয়া অসম্ভব । মুখ তুলে চাইলে না। বসে বসে এক দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে ইচ্ছা করছিলুম ঐ সুকুমার আঙুলগুলির ডগা দিয়ে স্পৰ্শীসুধা পড়ুক ঝরে আমার দেহে মনে | দরদ লাগল না তোমার কোনোখানেই । কৃপণ, সেটুকুও দিতে পারলে না ! মনে মনে বললুম, আরো বেশি দাম দিতে হবে বুঝি । একদিন ফাটা মাথা কাটা দেহ নিয়ে পড়ব মাটিতে, তখন ভেঙে-পড়া প্ৰাণটাকে নেবে তোমার কোলে তুলে ।” এলার চোখ ছলছলিয়ে এল, বললে, “আঃ, তোমার সঙ্গে পারি নে, অস্তু ! এটুকু না চেয়ে নিতে পারলে না ? কেড়ে নিলে না কেন আমার খাতা ? বুঝতে পার না, তোমারই সংকোচ আমাকে সংকুচিত করে । অন্তু, তোমার স্বভাব এক জায়গায় মেয়েদের মতো । ইচ্ছা থাকতে পারে প্রবল কিন্তু উদামভাবে তার দাবি প্রকাশ করতে তোমার রুচিতে ঠেকে ৷” 7ाटाउँछ। "বংশগত ধারণা, ছেলেবেলা থেকে রক্তে মাংসে জড়ানো । বরাবর ভেবে এসেছি মেয়েদের দেহে মনে একটা শুচিতার মর্যাদা আছে ; তাদের দেহের সম্মানকে সশঙ্কচিত্তে রক্ষা করা আমাদের পূর্বপুরুষগত অভ্যাস। আমার কুষ্ঠিত মনকে একটুমাত্র প্রশ্রয় দেবার জন্যে তোমার মন যদি কখনো আদ্র হয় তবে আমার পক্ষ থেকে ভিক্ষে চাইবার অপেক্ষা কোরো না । আমি শিখি নি তেমন করে ঠাইতে । ক্ষুধার সীমা নেই, তাই বলে পেটুক হতে পারব না, ওটা আমার ধাতে নেই। আমার কামনার কীেলীন্য নষ্ট করতে পারি। নে ৷” এলা অতীনের কাছে এসে ঘেঁষে বসিল, তার মাথা বুকে টেনে নিয়ে তার উপরে নিজের মাথা ইলিয়ে রাখলে । কখনো কখনো আস্তে আস্তে চুলের মধ্যে আঙুল বুলিয়ে দিতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে অতীন মাথা তুলে বসে এলার হাত চেপে ধরলে । বললে, “যেদিন মোকামায় খেয়াজাহাজে ড়ৈছিলুম সেদিন ভাগ্যদেবী পিতামহী অদৃশ্য হাতে কান মলে দিয়ে গেলেন তা বুঝতে পারিনি। তার অনতিকাল পর থেকেই মনটা কেবল আকাশকুসুম চয়ন করে বেড়াচ্ছে স্মৃতির আকাশে । সেদিনের