পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 Ου রবীন্দ্র-রচনাবলী কথা তোমার কাছে পুরোনো হয়েছে কি ?” "4क७ • ।" “তা হলে শোনো । ভারী মাল নীচের ডেক থেকে গাড়িতে নিয়ে গেছে আমার বিহারী চাকরিটী । কাছে ছিল ছোটাে একটা চামড়ার কেস-– এদিক ওদিকে তাকাচ্ছি কুলির অপেক্ষায় । নেহাত ভালোমানুষের মতো হঠাৎ কাছে এসে বললে, কুলি চান ? দরকার কী ! আমি নিচ্ছি।— ই ই', করেন কী, করেন কী, বলতে বলতেই সেটা তুলি ফেললে । আমার বিপত্তি দেখে যেন পুনশ্চ নিবেদনে বললে, সংকোচ বোধ করেন তো এক কাজ করুন, আমার বাক্সটা ঐ আছে তুলে নিন, পরস্পর ঋণ শোধ হয়ে যাবে। — তুলতে হল । আমার কেসের চেয়ে সাতগুণ ভারী । হাতলটাি ধরে ডান হাতে বা হাতে বদল করতে করতে টলতে টলতে রেলগাড়ির থার্ড ক্লাস কামরায় টেনে তুললেম । তখন সিল্পের জামা ঘামে ভিজে, নিশ্বাস দ্রুত, নিস্তব্ধ অট্টহাস্য তোমার মুখে । হয়তো বা করুণা কোনো একটা জায়গায় লুকোনো ছিল, সেটা প্রকাশ করা অকর্তব্য মনে করেছিলে । সেদিন আমাকে মানুষ করবার মহৎ দায়িত্ব ছিল তোমারই হাতে ।” “ছি ছি, বোলো না, বোলো না, মনে করতে লজ্জা বোধ হয় । কী ছিলুম তখন, কী বোকা, কী অদ্ভুত ! তখন তুমি হাসি "চেপে রাখতে বলেই আমার স্পর্ধ বেড়ে গিয়েছিল । সহ্য করেছিলে কী “থাক বা না থাক তাতে তো কিছু আসে যায় নি। সেদিন যে-পরিবেশের মধ্যে আমার কাছে দেখা দিয়েছিলে সে তো হায়ার ম্যাথম্যাটিকস নয়, লজিক নয়। সেটা যাকে বলে মোহ ৷ শংকরাচার্যের মতো মহামল্লও যার উপর মুদগরপাত করে একটু টােল খাওয়াতে পারেন নি। তখন বেলা পড়ে এসেছে, আকাশে যাকে বলে কনে-দেখা মেঘ । গঙ্গার জল লাল আভায় টলটল করছে । ঐ ছিপছিপে ক্ষিপ্রগমন শরীরটি সেই রাঙা আলোর ভূমিকায় চিরদিন আঁকা রয়ে গেল আমার মনে । কী হল তার পরে ? তোমার ডাক শুনলুম কানে । কিন্তু এসে পড়েছি কোথায় ? তোমার থেকে কতদূরে ! তুমিও কি জান তার সব বিবরণ ?” “আমাকে জানতে দাও না কেন অস্তু ?” “বারণ মানতে হয়। শুধু তাই কি ? কী হবে সব কথা বলে ?— আলো কমে গিয়েছে, এসে আরো কাছে এসো। আমার চোখ দুটাে এসেছে ছুটির দরবারে তোমার কাছে । একমাত্র তোমার কাছেই আমার ছুটি । অতি ছোটাে তার আয়তন, সোনার জলে রাঙানো ফ্রেমের মতো । তারই মধ্যে ছবিটিকে বধিয়ে নিই নে কেন ? ঐ-যে তোমার দুই-একগুছি অশিষ্ট চুল আলগা হয়ে চােখের উপর এসে পড়েছে, দ্রুত হাতে তুলে তুলে দিচ্ছ, কালো পাড় দেওয়া তসরের শাড়ি, ব্ৰোচ নেই কাধে, আঁচলটা মাথার চুলে বিধিয়ে রাখা, চােখে ক্লান্ত ক্লেশের ছায়া, ঠোঁটে মিনতির আভাস, চারি দিকে দিনের আলো ডুবে এসেছে শেষ অস্পষ্টতায় । এই যা দেখছি। এইটিই আশ্চর্য সত্য, এর মনে কী, কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারব না, কোনো এক অদ্বিতীয় কবির হাতেই ধরা দিতে পারল না বলে এর অব্যক্ত মাধুর্যের মধ্যে এত গভীর বিষাদ । এই ছােটাে একটি অপরূপ পরিপূর্ণতাকে চার দিকে ভূকুটি করে ঘিরে আছে বড়োনামওআলা বড়োছায়াওআলা। বিকৃতি ।” “কী বলছি, অন্তু ” “অনেকখানি মিথ্যে। মনে পড়ছে কুলি-বসতিতে আমাকে বাসা নিতে বলেছিলে। তোমার মনের মধ্যে ছিল আমার বংশের অভিমানকে ধূলিসাৎ করবার অভিপ্ৰায়। তোমার সেই সুমহৎ অধ্যবসায়ে আমার মজা লাগল। ডিমক্রাটিক পিকনিকে নাবা গেল। গাড়োয়ান-পাড়াতে ঘুরলাম। দাদা-খুড়োর সম্পর্ক পাতিয়ে চললুম। বহুবিধ মোষের গোয়ালঘরের পাশে পাশে । কিন্তু তাদেরও বুঝতে বাকি ছিল না, আমারও নয় যে এই সম্পর্কের ছাপগুলো ধোপ সইবে না | নিশ্চয় এমন মহৎ লোক আছেন সব যন্ত্রেই র্যাদের সুর বাজে, এমন-কি, তুলো-ধোনা যন্ত্ৰেও । আমরা নকল করতে গেলে সুর মেলে না ! দেখে নি তোমাদের পাড়ার খৃস্টশিষ্যকে ব্রাদার বলে যাকে-তাকে বুকে চেপে ধরা তার অনুষ্ঠানের