পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চার অধ্যায় । 8SV) অতীন বললে, “এলী, মনে করতে চেষ্টা করে আমরা আছি। পঞ্চাশ কি একশো বছর পরেকার এমনি এক নিস্তব্ধ রাতে। উপস্থিতের গণ্ডিটা নিতান্ত সংকীর্ণ, তার মধ্যে ভয়ভাবনা দুঃখকষ্ট সমস্তই প্ৰকাণ্ডতার ভান করে দেখা দেয়। বর্তমান সেই নীচ পদার্থ যার ছােটাে মুখে বড়ো কথা। ভয় দেখায় । সে মুখোশ পরে- যেন আমরা মুহূর্তের কোলে নাচানাে শিশু । মৃত্যু মুখোশখানা টান মেরে ফেলে দেয়। মৃত্যু অত্যুক্তি করে না। যা অত্যন্ত করে চেয়েছি তার গায়ে মোটা অঙ্কের দাম লেখা ছিল বর্তমানের ফকির কলমে, যা অত্যন্ত করে হারিয়েছি তার গায়ে দুদিনের কালি লেবেল মেরে লিখেছে অপরিসীম দুঃখ । মিথ্যে কথা ! জীবনটা জালিয়াত, সে অনন্তকালের হস্তাক্ষর জাল করে চালাতে চায়। মৃত্যু এসে হাসে, বঞ্চনার দলিলটা লোপ করে দেয়। সে হাসি নিষ্ঠুর হাসি নয়, বিদ্যুপের হাসি নয়, শিবের হাসির মতো সে শান্ত সুন্দর হাসি, মোহরাত্রির অবসানে। এালী, রাত্রে একলা বসে কখনো মৃত্যুর স্নিগ্ধ সুগভীর মুক্তি অনুভব করেছ, যার মধ্যে চিরকালের ক্ষমা ?” “তোমার মতো বড়ো করে দেখবার শক্তি আমার নেই অস্তু- তবু তোমাদের কথা মনে করে উদবেগে যখন অভিভূত হয়ে পড়ে মন, তখন এই কথাটা খুব নিশ্চিত করে অনুভব করতে চেষ্টা করি যে মরা সহজ ।” “ভীরু, মৃত্যুকে পালাবার পথ বলে মনে করছ কেন ? মৃত্যু সব চেয়ে নিশ্চিত- জীবনের সব গতিস্রোতের চরম সমুদ্র, সব সত্যমিথ্যা ভালোমন্দর নিঃশেষ সমন্বয় তার মধ্যে। এইরাত্রে এখনই -- Upwards Towards the peaks, Towards the Stars, Towards the vast Silence. এলা অতীনের হাত কোলে নিয়ে বসে রইল স্তব্ধ হয়ে । হঠাৎ অতীন হেসে উঠল। বললে, “পিছনে মরণের কালো পর্দাখানা নিশ্চল টানা রয়েছে অসীমে, তারই উপর জীবনের কৌতুকনাট্য নোচে চলেছে। অন্তিম অঙ্কের দিকে । তারই একটা ছবি আজ দেখে চেয়ে । আজ তিন বছর আগে এই ছাদের উপর তুমি আমার জন্মদিনের উৎসব করেছিলে, মনে আছে ?” “খুব মনে আছে।” “তোমার ভক্ত ছেলের দল সবাই এসেছিল। ভোজের আয়োজন ঘটা করে হয় নি। চিড়ে ভেজেছিলে সঙ্গে ছিল কলাইগুটি সিদ্ধ, মরিচের গুড়ো ছিটানো, ডিমের বাড়াও ছিল মনে পড়ছে। সবাই মিলে খেল কড়াকড়ি করে । হঠাৎ মতিলাল হাত পা ছুড়ে শুরু করলে, আজ নবযুগে অতীনবাবুর নবজন্মের দিন— আমি লাফ দিয়ে উঠে তার মুখ চেপে ধরলুম, বললুম, বক্তৃতা যদি কর, তবে তোমার পুরোনাে জন্মের দিনটা এইখানেই কাবার। বটু বললে, ছিছি। অতীনবাবু, বক্তৃতার ভূণহত্যা ?— নবযুগ, নবজন্ম, মৃত্যুর তোরণ প্রভৃতি ওদের বীধাবুলিগুলো শুনলে আমার লজ্জা করে । ওরা প্ৰাণপণে চেষ্টা করেছে আমার মনের উপর ওদের দলের তুলি বুলোতে— কিছুতে রঙ ধরল না ।” “অস্তু, নির্বোিধ আমি ; আমিই ভেবেছিলুম তোমাকে মিলিয়ে নেব আমাদের সকল পদাতিকের সঙ্গে এক উদি পরিয়ে ।” "তাই আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ওদের সঙ্গে ঘোরতর দিদিয়ানা করতে। ভেবেছিলে, আমার সংশোধনের পক্ষে কিছু ঈর্ষার প্রয়ােজন আছে। স্নেহযত্ন, কুশলসম্ভাষণ, বিশেষ মন্ত্রণা, অনাবশ্যক উদবেগ, মনিহারির রঙিন সামগ্ৰীর মতো। ওদের সামনে সাজিয়ে রেখেছিলে তোমার পসরায়। আজও তোমার করুণ প্রশ্ন কানে শুনতে পাচ্ছি, নন্দকুমার, তোমার চোখমুখ লাল দেখছি কেন । বেচারা ভালোমানুষ, সত্যের অনুরোধে মাথাধরা অস্বীকার করতে না-করতে ছেড়া ন্যাকড়ার জলপটি এসে