পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 NR রবীন্দ্র-রচনাবলী । প্রকাণ্ড নাট্যশালার চারিদিকে উৎসবের ভগ্নাবশেষ পড়িয়া আছে। সাড়শব্দ নাই, প্রাণ নাই, চেতনা নাই, হৃদয়ের তরঙ্গ স্তব্ধ। এক দিকে পর্বতের সুদীর্ঘ ছায়া পড়িয়ছে- এক দিকে চাঁদের আলো । মাঝে মাঝে পাঁচ-ছয়টা করিয়া বড়ো বড়ো গাছ ঝাঁকড়া মাথা লইয়া শাখাপ্রশাখা জটাজুট্‌ আঁধার কািরয়া ইন্দ্ৰকুমার যুদ্ধের সমস্ত সংবাদ পাইয়া যখন যুবরাজকে খুঁজতে আসিয়াছেন, তখন তিনি কর্ণফুলি নদীর তীরে ঘাসের শয্যার উপর শুইয়া আছেন। মাঝে মাঝে অঞ্জলি পুরিয়া জলপান করিতেছেন, মাঝে মাঝে নিতান্ত অবসন্ন হইয়া চােখ বুজিয়া অসিতেছে। দূর সমুদ্রের দিক হইতে বাতাম আসিতেছে। কনের কাছে কুলকুল করিয়া নদীর জল বহিয়া আসিতেছ। জনপ্রাণী নাই। চারিদিকে বিজন পর্বত দাঁড়াইয়া আছে, বিজন অরণ্য বা বা করিতেছে- আকাশে চন্দ্র একাকী, জ্যোৎস্নালোকে অনন্ত নীলাকাশ পাণ্ডুবৰ্ণ হইয়া গিয়াছে। এমন সময়ে ইন্দ্ৰকুমার যখন বিদীর্ণ্যুদয়ে "দাদা" বলিয়া ডাকিয়া উঠিলেন, তখন আকাশপাতাল যেন শিহরিয়া উঠিল। চন্দ্রনারায়ণ চমকিয়া জাগিয়া “এসো ভাই" বলিয়া আলিঙ্গনের জন্য দুই হাত বাড়াইয়া দিলেন। ইন্দ্ৰকুমার দাদার আলিঙ্গনের মধ্যে বদ্ধ হইয়া শিশুর মতে কঁদিতে লাগিলেন। চন্দ্রনারায়ণ ধীরে ধীরে বললেন, “আঃ, বচিলাম ভাই। তুমি আসিবে জানিয়াই এতক্ষণ কোনােমতে আমার প্রাণ বাহির হইতেছিল না। ইন্দ্ৰকুমার, তুমি আমার উপরে অভিমান করিয়াছিল, তোমার সেই অভিমান লইয়া কি আমি মরিতে পারি। আজ আবার দেখা হইল, তোমার প্রেম আবার ফিরিয়া পাইলাম— এখন মরিতে আর কোনো কষ্ট নই।" বলিয়া দুই হাতে তাহার তীর উৎপাটন করলেন | রজ্ঞ ভূটিয়া পড়িল, তাহার শরীর হিম হইয়া আসিল— মৃদুস্বরে বললেন, "মরিলাম তাহাতে দুঃখ নাই। কিন্তু আমাদের পরাজয় হইল।” ইন্দ্ৰকুমার কাদিয়া কহিলেন, "পরাজয় তোমার হয় নাই দাদা, পরাজয় আমারই হইয়াছে।" চন্দ্রনারায়ণ ঈশ্বরকে স্মরণ করিয়া হত জোড় করিয়া কহিলেন, "দয়াময়, ভবের খেলা শেষ করি? আসিলাম, এখন তোমার কালে স্থান দাও।” বলিয়া চক্ষু মুদ্রিত করলেন। ভোরের বেলী নদীর পশ্চিম পাড়ে চন্দ্র যখন পাণ্ডুবৰ্ণ হইয়া আসিল চন্দ্রনারায়ণের মুদ্রিতািনঃ মুখচ্ছবিও। তখন পাণ্ডুবৰ্ণ হইয়া গেল ! চন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গেই তীহার জীবন অস্তমিত হইল।