পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ধর্ম 8(፩ ዓ. আমি এখন তোমার নিকট শক্তি প্রার্থনা করি না, আমাকে প্রেম দাও ; আমি সংসারে জয়ী হইতে চাহি না, তোমার নিকট প্রণত হইতে চাই ; আমি সুখদুঃখকে অবজ্ঞা করিতে চাহি না, সুখদুঃখকে তোমার মঙ্গলহস্তের দান বলিয়া বিনয়ে গ্ৰহণ করিতে চাই। মৃত্যু যখন আমার কর্মশালার দ্বারে দাড়াইয়া নীরবসংকেতে আহবান করিবে, তখন যেন তাহার অনুসরণ করিয়া, জননী, তোমার অন্তঃপুরের শান্তিকক্ষে নিঃশঙ্কহীদয়ের মধ্যে আমি ক্ষমা লইয়া যাই, গ্ৰীতি লইয়া যাই, কল্যাণ লইয়া যাইবিরোধের সমস্ত দাহ যেন সেদিন সন্ধ্যাহ্মানে জুড়াইয়া যায়, সমস্ত বাসনার পঙ্ক যেন ধীেত হয়, সমস্ত কুটিলতাকে যেন সরল, সমস্ত বিকৃতিকে যেন সংস্কৃত করিয়া যাইতে পারি। যদি সে অবকাশ না ঘটে, যদি ক্ষুদ্রবল নিঃশেষিত হইয়া যায়, তবু তোমার বিশ্ববিধানের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করিয়া যেন দিন হইতে রাত্রে, জীবন হইতে মৃত্যুতে, আমার অক্ষমতা হইতে তোমার করুণার মধ্যে একান্তভাবে আত্মবিসর্জন করিতে পারি। ইহা যেন মনে রাখি— জীবনকে তুমিই আমার প্রিয় করিয়াছিলে, মরণকেও তুমিই আমার প্রিয় করিবে- তোমার দক্ষিণহস্তে তুমি আমাকে সংসারে প্রেরণ করিয়াছিলে, তোমার বামহস্তে তুমি আমাকে ক্ৰোড়ে আকর্ষণ করিয়া লইবে- তোমার আলোক আমাকে শক্তি দিয়াছিল, তোমার অন্ধকার আমাকে শান্তি দিবে। ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ >○〉の भनूषा উত্তিষ্ঠত ! জাগ্ৰত ' উত্থান করো, জাগ্রত হও— এই বাণী উদঘোষিত হইয়া গেছে। আমরা কে শুনিয়াছি, কে শুনি নাই, জানি না- কিন্তু “উত্তিষ্ঠত, জাগ্রত’ এই বাক্য বার বার আমাদের দ্বারে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। সংসারের প্রত্যেক বাধা প্রত্যেক দুঃখ প্রত্যেক বিচ্ছেদ কতশতবার আমাদের অন্তরাত্মার তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে আঘাত দিয়া যে-ঝংকার দিয়াছে, তাহাতে কেবল এই বাণীই ঝংকৃত হইয়া উঠিয়াছে “উত্তিষ্ঠত, জাগ্ৰত - উত্থান করো, জাগ্রত হও। অশ্রুশিশির ধৌত আমাদের নবজাগরণের জন্য নিখিল অনিমেষনেত্ৰে প্ৰতীক্ষা করিয়া আছে- কবে সেই প্ৰভাত আসিবে, কবে সেই রাত্রির অন্ধকার অপগত হইয়া আমাদের অপূর্ব বিকাশকে নির্মল নবােদিত অরুণালোকে উদঘাটিত করিয়া দিবে। কবে আমাদের বহুদিনের বেদনা সফল হইবে, আমাদের অশ্রুধারা সার্থক হইবে । পুষ্পকে আজ প্ৰাতঃকালে বলিতে হয় নাই যে, রজনী প্রভাত হইল— তুমি আজ প্রস্ফুটিত হইয়া ওঠে !' বনে বনে আজ বিচিত্র পুষ্পগুলি অতি অনায়াসেই বিশ্বজগতের অন্তৰ্গঢ় আনন্দকে বর্ণে গন্ধে শোভায় বিকশিত করিয়া মাধুর্যের দ্বারা নিখিলের সহিত কমনীয়ভাবে আপনার সম্বন্ধ স্থাপন করিয়াছে। পুষ্প আপনাকেও পীড়ন করে নাই, অন্য কাহাকেও আঘাত করে নাই, কোনো অবস্থায় দ্বিধার লক্ষণ দেখায় নাই, সহজসার্থকতায় আদ্যোপােন্ত প্ৰফুল্ল হইয়া উঠিয়াছে। ইহা দেখিয়া মনের মধ্যে এই আক্ষেপ জন্মে যে, আমার জীবন কেন বিশ্বব্যাপী আনন্দাকিরণপাতে এমনি সহজে, এমনি সম্পূর্ণভাবে বিকশিত হইয়া উঠে না ? সে তাহার সমস্ত দলগুলি সংকুচিত করিয়া আপনার মধ্যে এত প্ৰাণপণে কী আঁকড়িয়া রাখিতেছে ? প্রভাতে তরুণ সূর্য আসিয়া অরুণাকরে তাহার মেলিয়া দিয়াছি, তুমি তেমন সহজে আনন্দে বিশ্বের মাঝখানে আপনাকে অবাধিত করিয়া দাও।” অতলস্পর্শ অন্ধকারের মধ্য হইতে আমার সমস্ত জ্যোতিঃসম্পদ উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছি, তুমি তেমনি করিয়া একবার অন্তরের গভীর-তলের দ্বার নিঃশব্দে উদঘাটন করিয়া দাও- আত্মার প্রচ্ছন্ন রাজভাণ্ডার একমুহূর্তে বিস্মিত বিশ্বের সম্মুখীন করো।” নিখিল জগৎ প্রতিক্ষণেই তাহার বিচিত্র স্পর্শের