পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ধর্ম 8@决 সমস্ত শক্তি জাগ্ৰত, সমস্ত তেজ উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিয়াছে, সেই আত্মাই ব্ৰহ্মকে যথার্থভাবে লাভ করিবার উদ্যম প্রাপ্ত হয়- ক্ষুদ্র আরামের মধ্যে, ভোগবিলাসের মধ্যে যে আত্মা জড়ত্বে আবিষ্ট হইয়া আছে, ব্ৰহ্মের আনন্দ তাহার নহে। সেইজন্য উপনিষদ বলিয়াছেন নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ । এই আত্মা (জীবাত্মাই বল, পরমাত্মাই বল) ইনি বলহীনের দ্বারা লভ্য নহেন । সমগ্ৰ শক্তিকে সম্পূর্ণভাবে প্রয়োগ করিবার যত উপলক্ষ ঘটে, ততই আত্মাকে প্রকৃতভাবে লাভ করিবার উপায় হয়। এইজন্যই পুষ্পের পক্ষে পুষ্পত্বি যত সহজ, মানুষের পক্ষে মনুষ্যত্ব তত সহজ নহে। মনুষ্যত্বের মধ্য দিয়া মানুষকে যাহা পাইতে হইবে, তাহা নিদ্রিত অবস্থায় পাইবার নহে। এইজন্যই সংসারের সমস্ত কঠিন আঘাত “ আমাদিগকে এই কথা বলিতেছে উক্তিষ্ঠিত জাগ্ৰত প্রাপ্য বরান নিবোধত । ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দূরত্যয়া দুর্গং পথ্যস্তৎকবয়ো বদন্তি । উঠ, জাগো, যথার্থ গুরুকে প্রাপ্ত হইয়া বোধিলাভ করে । সেই পথ শাণিত ক্ষুরধারের ন্যায় দুৰ্গম, কবিরা এইরূপ বলেন । অতএব প্ৰভাতে যখন বনে-উপবনে পুষ্প-পল্লবের মধ্যে তাঁহাদের ক্ষুদ্র সম্পূর্ণতা, তাহাদের সহজ শোভা পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হইয়া উঠিয়াছে, তখন মানুষ আপন দুৰ্গম পথ আপন দুঃসহ দুঃখ আপন বৃহৎ অসমাপ্তির গীেরবে মহত্তর বিচিত্ৰতর আনন্দের গীত কি গাহিবে না ? যে প্রভাতে তরুলতার মধ্যে কেবল পুষ্পের বিকাশ এবং পল্লবের হিল্লোল, পাখির গান এবং ছায়ালোকের স্পন্দন, সেই শিশিরধৌত জ্যোতির্ময় প্রভাতে মানুষের সম্মুখে সংসার— তাহার সংগ্রামক্ষেত্ৰ— সেই রমণীয় প্রভাতে মানুষকেই বদ্ধপরিকর হইয়া তাহার প্রতিদিনের দুরূহ জয়চেষ্টার পথে ধাবিত হইতে হইবে, ক্লেশকে বরণ করিয়া লইতে হইবে, সুখদুঃখের উত্তাল তরঙ্গের উপর দিয়া তাহাকে তরণী বাহিতে হইবে- কারণ, মানুষ মহৎ ; কারণ, মনুষ্যত্ব সুকঠিন, এবং মানুষের যে পথ, 'দুর্গং পথ্যস্তৎ কবয়ো বদন্তি । কিন্তু সংসারের মধ্যেই যদি সংসারের শেষ দেখি, তবে দুঃখকষ্টের পরিমাণ অত্যন্ত উৎকট হইয়া উঠে, তাহার সামঞ্জস্য থাকে না । তবে এই বিষম ভার কে বহন করিবে ? কেনই বা বহন করিবে ? কিন্তু যেমন নদীর এক প্রান্তে পরমবিরাম সমুদ্র, অন্য দিকে সুদীর্ঘতটনিরুদ্ধ অবিরাম-যুধ্যমান জলধারা, তেমনি আমাদেরও যদি একই সময়ে এক দিকে ব্ৰহ্মের মধ্যে বিশ্রাম ও অন্য দিকে সংসারের মধ্যে অবিশ্রাম গতিবেগ না থাকে, তবে এই গতির কোনোই তাৎপর্য থাকে না, আমাদের প্রাণপণ চেষ্টা অদ্ভুত উন্মত্তত হইয়া দাঁড়ায় । ব্রহ্মের মধ্যেই আমাদের সংসারের পরিণাম, আমাদের কর্মের গতি । শাস্ত্ৰ বলিয়াছেন— ব্রহ্মনিষ্ঠ গৃহস্থ যদযৎ কর্মপ্রকুবীত তদব্ৰহ্মণি সমৰ্পয়েৎ | যে-য্যে কর্ম করিবেন, তাহা ব্রহ্মে সমর্পণ করিবেন । ইহাতে একই কালে কর্ম এবং বিরাম, চেষ্টা এবং শান্তি, দুঃখ এবং আনন্দ । ইহাতে এক দিকে আমাদের আত্মার কর্তৃত্ব থাকে ও অন্যদিকে যেখানে সেই কর্তৃত্বের নিঃশেষে বিলয়, সেইখানে সেই কর্তৃত্বকে প্রতিক্ষণে বিসর্জন দিয়া আমরা প্রেমের আনন্দলাভ করি । প্ৰেম তো কিছু না দিয়া বীচিতে পারে না। আমাদের কর্ম, আমাদের কর্তৃত্ব যদি একেবারেই আমাদের না হইত, তবে ব্রহ্মের মধ্যে বিসর্জন দিতাম। কী ? তবে ভক্তি তাহার সার্থকতা লাভ করিত কেমন করিয়া ? সংসারেই আমাদের কর্ম, আমাদের কর্তৃত্ব, তাহাই আমাদের দিবার জিনিস। আমাদের প্রেমের চরম সার্থকতা হইবে- যখন আমাদের সমস্ত কর্ম, সমস্ত কর্তৃত্ব আনন্দে ব্ৰহ্মকে সমর্পণ করিতে পারিব । নতুবা কর্ম আমাদের পক্ষে নিরর্থক ভার ও কর্তৃত্ব বস্তুত সংসারের দাসত্ব হইয়া উঠিবে। পতিব্ৰতা স্ত্রীর পক্ষে তাহার পতিগৃহের কর্মই গৌরবের, তাহা আনন্দের- সে কর্ম তাহার বন্ধন নহে, পতিপ্রেমের মধ্যেই তাহা প্রতিক্ষণেই মূর্তিলাভ করিতেছে— এক পতিপ্রেমের মধ্যেই "||○o