পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8\2ề রবীন্দ্র-রচনাবলী সংসারের দ্বারা সেই ভূমীকে খণ্ডিত জড়িত করিলে চলিবে না । একটি উদাহরণ দিই। গৃহ আমাদের পক্ষে প্রয়োজনীয়, তাহা আমাদের বাসযোগ্য। মুক্ত আকাশ আমাদের পক্ষে সেরূপ বাসযোগ্য নহে, কিন্তু এই মুক্ত আকাশকে মুক্ত রাখাই আমাদের পক্ষে একান্ত আবশ্যক । মুক্ত আকাশের সহিত আমাদের গৃহস্থিত আকাশের অবাধ যোগ রাখিলেই তবেই আমাদের গৃহ আমাদের পক্ষে কারাগার, আমাদের পক্ষে কবরস্বরূপ হয় না। কিন্তু যদি বলি, আকাশকে গৃহেরই মতো আমার আপনার করিয়া লইব- যদি আকাশের মধ্যে কেবলই প্রাচীর তুলিতে থাকি, তবে তাহাতে আমাদের গৃহেরই বিস্তার ঘটিতে থাকে, মুক্ত আকাশ দূর হইতে সুদূরে চলিয়া যায়। আমরা যদি বৃহৎ ছাদ পত্তন করিয়া সমস্ত আকাশকে আমার আপনার করিয়া লইলাম বলিয়া কল্পনা করি, তবে আলোকের জন্মভূমি, ভুর্ভুবঃস্বলোকের অনন্ত ক্ৰীড়াক্ষেত্র আকাশ হইতে নিজেকে বঞ্চিত করি। যাহা নিতান্ত সহজেই পাওয়া যায়, সহজে ব্যতীত আর-কোনাে উপায়ে যাহা পাওয়া যায় না, নিজের প্রভূত চেষ্টার দ্বারাতেই তাহাকে একেবারে দুর্লভ করিয়া তোলা হয় | বেষ্টন করিয়া লইয়া সংসারের আর-সমস্ত পাওয়াকে আমরা পাইতে পারি।-- কেবল ধর্মকে, ধর্মের অধীশ্বরকে বেষ্টন ভাঙিয়া দিয়া আমরা পাই | সংসারের লাভের পদ্ধতিদ্বারা সংসারের অতীতকে পাওয়া যায় না । বস্তুত যেখানে আমরা না পাইবার আনন্দের অধিকারী, সেখানে পাইবার ব্যর্থ চেষ্টা করিয়া আমরা হারাই মাত্র । সেইজন্য ঋষি বলিয়াছেন--- যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ | আনন্দং ব্ৰহ্মণো বিদ্বান ন বিভেতি কৃতশচন ৷ মনের সহিত বাক্য যাহাকে না পাইয়া নিবৃত্ত হয়, সেই ব্ৰহ্মের আনন্দ যিনি জানিয়াছেন, তিনি কিছু হইতেই ভয় পান না । ধর্মের সরল আদর্শ একদিন আমাদের ভারতবর্ষেরই ছিল । উপনিষদের মধ্যে তাহার পরিচয় পাই । তাহার মধ্যে যে ব্রহ্মের প্রকাশ আছে, তাহা পরিপূর্ণ, তাহা অখণ্ড, তাহা আমাদের কল্পনা-জালদ্বারা भङ|९ 76न्Nन्४९ ३ তিনিই সত্য, নতুবা এ জগৎসংসার কিছুই সত্য হইত না । তিনিই জ্ঞান, এই যাহা-কিছু তাহা তাহারই জ্ঞান, তিনি যাহা জানিতেছেন, তাহাই আছে, তাহাই সত্য । তিনি অনন্ত । তিনি অনন্ত সত্য, তিনি VNÈ 3 এই বিচিত্র জগৎসংসারকে উপনিষদ ব্রহ্মের অনন্ত সত্যে, ব্রহ্মের অনন্ত জ্ঞানে বিলীন করিয়া দেখিয়াছেন । উপনিষদ কোনো বিশেষ লোক কল্পনা করেন নাই, কোনো বিশেষ মন্দির রচনা করেন নাই, কোনো বিশেষ স্থানে তাহার বিশেষ মূর্তি স্থাপন করেন নাই— একমাত্র তীহাকেই পরিপূর্ণভাবে সর্বত্র উপলব্ধি করিয়া সকলপ্রকার জটিলতা সকলপ্রকার কল্পনার চাঞ্চল্যকে দূরে নিরাকৃত করিয়া দিয়াছেন | ধর্মের বিশুদ্ধ সরলতার এমন বিরাট আদর্শ আর কোথায় আছে ? উপনিষদের এই ব্ৰহ্ম আমাদের অগম্য, এই কথা নির্বিচারে উচ্চারণ করিয়া ঋষিদের অমর বাণীগুলিকে আমরা যেন আমাদের ব্যবহারের বাহিরে নির্বাসিত করিয়া না রাখি । আকাশ লোষ্ট্রখণ্ডের ন্যায় আমাদের গ্রহণযোগ্য নয় বলিয়া আমরা আকাশকে দুৰ্গম বলিতে পারি না । বস্তুত সেই কারণেই তাহা সুগম। যাহা ধারণাযোগ্য, যাহা স্পর্শগম্য, তাহাই আমাদিগকে বাধা দেয়। আমাদের স্বহস্তেরচিত ক্ষুদ্র প্রাচীর দুৰ্গম, কিন্তু অনন্ত আকাশ দুর্গম নহে। প্রাচীরকে লঙঘন করিতে হয়, কিন্তু আকাশকে লঙঘন করিবার কোনো অর্থই নাই | প্ৰভাতের অরুণালোক স্বর্ণমুষ্টির ন্যায় সঞ্চয়যোগ্য নহে, সেই কারণেই কি অরুণালোককে দুর্লভ বলতে হইবে ? বস্তুত একমুষ্টি স্বর্ণই কি দুর্লভ নহে, আর আকাশপূৰ্ণ প্রভাতকরণ কি কাহাকেও ক্রয় করিয়া আনিতে হয় ? প্ৰভাতের আলোককে মূল্য দিয়া ক্রয় করিবার কল্পনাই মনে আসিতে পারে না- তাহা দুমূল্য নহে, তাহা অমূল্য ।