পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 VV রবীন্দ্র-রচনাবলী তাহার লোলুপতা ক্রমেই বিশ্বের প্রতি দারুণভােব ধারণ করে | সুখকে বাহিরে কল্পনা করিয়া বিশ্বকে মৃগয়ার মৃগের মতো নিষ্ঠুরবেগে তাড়না করিয়া ফিরিলে জীবনের শেষমূহুর্ত পর্যন্ত কেবল ছাটাছুটিই সার হয় এবং পরিণামে শিকারির উদ্দাম অশ্ব তাঁহাকে কোন অপঘাতের মধ্যে নিক্ষেপ করে, তাহার ऎका •७शी यश न | এইরূপ উন্মত্তভাবে যখন আমরা ছুটিতে থাকি, তখন আমাদের আগ্রহের অসহ্যবেগে সমস্ত জগৎ অস্পষ্ট হইয়া যায়। আমাদের চারিদিকে পদে পদে যে-সকল অযাচিত আনন্দ প্রভূত প্রাচুর্যের সহিত করিয়া চলিয়া যাই | জগতের অক্ষয় আনন্দের ভাণ্ডারকে আমরা কেবল ছুটিতে ছুটতেই দেখিতে পাই না | এইজন্যই ভারতবর্ষ বলিতেছেন : সংযতো ভবেৎ। । প্রবৃত্তিবেগ সংযত করে । চাঞ্চল দূর হইলেই সন্তোষের স্তব্ধতার মধ্যে জগতের সমস্ত বৃহৎ আনন্দগুলি আপনি প্রকাশিত হইবে । গতিবেগের প্রমত্ততাবশতই আমরা সংসারের যে-সকল স্নেহ-প্ৰেম-সৌন্দর্যকে, প্রতিদিনের শতশত মঙ্গলভাবের আদানপ্রদানকে লক্ষ্য করিতে পারি নাই, সংযত হইয়া, স্থির হইয়া তাঁহাদের প্রতি দৃষ্টিপাত যাহা নাই, তাহারই শিকারে বাহির হইতে হইবে, ভারতবর্ষ এ পরামর্শ দেয় না— ছুটাছুটিই যে চরম সার্থকতা, এ কথা ভারতবর্ষের নহে। যাহা অন্তরে বাহিরে চারি দিকেই আছে, যাহা অজস্ৰ, যাহা ধ্রুব, যাহা সহজ, ভারতবর্ষ তাহাকেই লাভ করিতে পরামর্শ দেয়- কারণ, তাহাই সত্য, তাহাই নিত্য | যিনি অন্তরে আছেন তাহাকে অন্তরেই লাভ করিতে ভারতবর্ষ বলে, যিনি বিশ্বে আছেন তাহাকে বিশ্বের মধ্যেই উপলব্ধি করা ভারতবর্ষের সাধনা— আমরা যে অমৃতলোকে সহজেই বাস করিতেছি, দৃষ্টির বাধা দূর করিয়া তাহাকে প্রত্যক্ষ করিবার জন্যই ভারতবর্ষের প্রার্থনা— চিত্তসরোবরের যে অনাবিল অচাঞ্চল্য, যাহার নাম সন্তোষ, আনন্দের যাহা দৰ্পণ, তাহাকেই সমস্ত ক্ষোভ হইতে রক্ষা করা, ইহাই ভারতবর্ষের শিক্ষা । কিছু কল্পনা করা নহে, রচনা করা নহে, আহরণ করা নহে ; জাগরিত হওয়া, বিকশিত হওয়া, প্রতিষ্ঠিত হওয়া- যাহা আছে তাহাকে গ্ৰহণ করিবার জন্য অত্যন্ত সরল হওয়া ! যাহা সত্য তাহা সত্য বলিয়াই আমাদের নিকটতম, সত্য বলিয়াই তাহা দিবালোকের ন্যায় আমাদের সকলেরই প্রাপ্য, তাহা আমাদের স্বরচিত নহে বলিয়াই তাহা আমাদের পক্ষে সুগম, তাহা আমাদের সম্যক-ধারণার অতীত বলিয়াই তাহা আমাদের চিরজীবনের আশ্রয়— তাহার প্রতিনিধিমাত্রই তাহা অপেক্ষা সুদূর— তাহাকে আমাদের কোনো আবশ্যক-বিশেষের উপযোগিরূপে, বিশেষ আয়ত্তগম্যরূপে সহজ করিতে চেষ্টা করিতে গেলেই তাহাকে কঠিন করা হয়, তাহাকে পরিত্যাগ করা হয়— অধীর হইয়া তাহাকে বাহ্যাড়ম্বরের মধ্যে খুঁজিয়া বেড়াইলে নিজের সৃষ্টিকেই খুজিয়া ফিরিতে হয়— এইরূপ চেষ্টার উপস্থিত উত্তেজনামাত্র লাভ করি, কিন্তু চরম সার্থকতা প্ৰাপ্ত হই না । আজ আমরা ভারতবর্ষের সেই উপদেশ ভুলিয়াছি, তাহার অকলঙ্ক সরলতম বিরাটতম একনিষ্ঠ আদর্শ হইতে ভ্ৰষ্ট হইয়া শতধাবিভক্ত খর্বতা-খণ্ডতার দুৰ্গম গহন মধ্যে মায়ামূগীর অনুধাবন করিয়া ফিরিতেছি। হে ভারতবর্ষের চিরারাধ্যতম অন্তৰ্যামী বিধাতুপুরুষ, তুমি আমাদের ভারতবর্ষকে সফল করো। ভারতবর্ষের সফলতার পথ একান্ত সরল একনিষ্ঠতার পথ । তোমার মধ্যেই তাহার ধর্ম, কর্ম, তাহার চিত্ত পরম ঐক্যলাভ করিয়া জগতের, সমাজের, জীবনের সমস্ত জটিলতার নির্মল সহজ মীমাংসা করিয়াছিল । যাহা স্বার্থের, বিরোধের, সংশয়ের নানা শাখাপ্রশাখার মধ্যে আমাদিগকে উত্তীর্ণ করিয়া দেয়, যাহা বিবিধের আকর্ষণে আমাদের প্রবৃত্তিকে নানা অভিমুখে বিক্ষিপ্ত করে, যাহা উপকরণের নানা জঞ্জালের মধ্যে আমাদের চেষ্টাকে নানা আকারে ভ্ৰাম্যমাণ করিতে থাকে, তাহা ভারতবর্ষের পন্থী নহে । ভারতবর্ষের পথ একের পথ, তাহা বাধাবর্জিত তোমারই পথ— আমাদের বৃদ্ধ পিতামহদের পদাঙ্কচিহ্নিত সেই প্রাচীন প্রশস্ত পুরাতন সরল রাজপথ। যদি পরিত্যাগ না করি, তবে কোনোমতেই আমরা ব্যর্থ হইব না । জগতের মধ্যে অদ্য দারুণ দুর্যোগের দুদিন উপস্থিত হইয়াছে— চারি দিকে যুদ্ধভেরী বাজিয়া উঠিয়াছে— বাণিজ্যরথ দুর্বলকে ধূলির সহিত দলন করিয়া ঘর্ঘরশব্দে চারিদিকে