পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8V2br রবীন্দ্র-রচনাবলী পুরুষে সেই পরিপূর্ণে এ সমস্তই পূর্ণ। সমস্ত পথ শেষ হইল, সমস্ত পথের কষ্ট দূর হইয়া গেল। তখন অন্তহীন কাৰ্য-কারণের “ক্লান্তিকর শাখাপ্রশাখা হইতে উত্তীর্ণ হইয়া জ্ঞান বলিল । একধৈবানুদ্রষ্টব্যমেতদপ্রমেয়ং ধ্রুবম | বিচিত্র বিশ্বের চঞ্চল বহুত্বের মধ্যে এই অপরিমেয় ধ্রুবকে একধাই দেখিতে হইবে । সহস্ৰ বিভীষিকা ও বিস্ময়ের মধ্যে দেবতা-সন্ধানশ্রান্ত ভক্তি তখন বলিল ; এষ সৰ্বেশ্বর এষ ভূতাধিপতিরোষ ভূতপাল এয সেতুবিধারণ এষাং লোকনামসম্ভেদায় । এই একই সকলের ঈশ্বর, সকল জীবের অধিপতি, সকল জীবের পালনকর্তা— এই একই সেতুস্বরূপ হইয়া সকল লোককে ধারণ করিয়া ধ্বংস হইতে রক্ষা করিতেছেন । বাহিরের বহুতর আঘাতে আকর্ষণে ক্লিষ্ট-বিক্ষিপ্ত প্ৰেম কহিল— তদেতৎ প্ৰেয়ঃ পুত্রাৎ প্রেয়ো বিত্তাৎ প্রেয়োহনাত্মাৎ সর্বস্মাদন্তরিতরাং যদায়মাত্মা | সেই যে এক, তিনি, সকল হইতে অন্তরতর পরমাত্মা, তিনিই পুত্ৰ হইতে প্রিয়, বিত্ত হইতে প্রিয়, অন্য সকল হইতেই প্রিয়। মুহূর্তেই বিশ্বের বহুত্ব বিরোধের মধ্যে একের ধ্রুবশান্তি পরিপূর্ণ হইয়া দেখা দিল— একের সত্য, একের অভয়, একের আনন্দ বিচ্ছিন্ন জগতকে এক করিয়া অপ্ৰমেয় সৌন্দর্যে গাথিয়া তুলিল । শিশির-নিষিক্ত শীতের প্রত্যুষে পূর্ব দিক যখন অরুণবর্ণ, লঘুবাষ্পাচ্ছন্ন বিশাল প্রান্তরের মধ্যে আসন্ন জাগরণের একটি অখণ্ড শান্তি বিরাজমান— যখন মনে হয়, যেন জীবধাত্রী মাতা বসুন্ধরা ব্ৰাহ্মমুহূর্তে প্রথম নেত্র উন্মীলন করিয়াছেন, এখনাে সেই বিশ্বগেহিনী তাহার বিপুল গৃহের অসংখ্যজীবপালনকার্য আরম্ভ করেন নাই, তিনি যেন দিবসারম্ভে ওংকারমন্ত্র উচ্চারণ করিয়া জগন্মন্দিরের উদঘাটিত স্বৰ্ণতােরণদ্বরে ব্ৰহ্মাণ্ডপতির নিকট মস্তক অবনত করিয়া স্তব্ধ হইয়া আছেন—তখন যদি চিন্তা করিয়া দেখি, তবে প্ৰতীতি হইবে, সেই নির্জন নিঃশব্দ নীহারমণ্ডিত প্ৰান্তরের মধ্যে প্রয়াসের অন্ত নাই | প্রত্যেক তৃণদলের অণুতে অণুতে জীবনের বিচিত্র চেষ্টা নিরন্তর, প্রত্যেক শিশিরের কণায় কণায় সংযোজন-বিযোজন-আকর্ষণ-বিকর্ষণের কার্য বিশ্রামবিহীন । অথচ এই অশ্রান্ত অপরিমেয় কর্মব্যাপারের মধ্যে শান্তিসৌন্দর্য অচল হইয়া আছে। অদ্য এই মুহূর্তে এই প্রকাণ্ড পৃথিবীকে যে প্রচণ্ড শক্তি প্রবলবেগে শূন্যে আকর্ষণ করিয়া লইয়া চলিয়াছে, সে শক্তি আমাদের কাছে কথাটিমাত্র কহিতেছে না, শব্দটিমাত্র করিতেছে না। অদ্য এই মুহুর্তে পৃথিবীকে পরিবেষ্টন করিয়া সমস্ত মহাসমুদ্রে যে লক্ষলক্ষ তরঙ্গ সগর্জন তাণ্ডবনৃত্য করিতেছে, শতসহস্ৰ নদনদীনিঝরে যে কল্লোল উঠিতেছে, অরণ্যেঅরণ্যে যে আন্দোলন, পল্লবে-পল্লবে যে মর্মরধ্বনি, আমরা তাহার কি জানিতেছি । বিশ্বব্যাপী যে মহাকর্মশালায় দিবারাত্ৰি লক্ষকোটি জ্যোতিষ্কদীপের নির্বাণ নাই, তাহার অনন্ত কলরব কাহাকে বধির করিয়াছে— তাহার প্রচণ্ড প্রয়াসের দৃশ্য কাহাকে পীড়িত করিতেছে ? এই কৰ্মজালবেষ্টিত পৃথিবীকে যখন বৃহদভাবে দেখি, তখন দেখি, তাহা চিরদিন অক্লান্ত অক্লিষ্ট প্রশান্ত সুন্দর— এত কর্মে, এত চেষ্টায়, এত জন্মমৃত্যু-সুখদুঃখের অবিশ্রাম চক্ররেখায় সে চিন্তিত চিহ্নিত ভারাক্রান্ত হয় নাই । চিরদিনই তাহার প্রভাত কী সীেমাসুন্দর, তাহার মধ্যাহ্ন। কী শান্ত গভীর, তাহার সায়াহ্ন, কী করুণ-কোমল, তাহার রাত্রি কী উদার-উদাসীন । এত বৈচিত্র্য এবং প্রয়াসের মধ্যে এই স্থির শান্তি এবং সৌন্দর্য, এত কলরবের মধ্যে এই পরিপূর্ণ সংগীত কী করিয়া সম্ভবপর হইল ? ইহার এক উত্তর এই যে : বৃক্ষ ইব স্তব্ধো দিবি তিষ্ঠত্যেকঃ। মহাকাশে বৃক্ষের ন্যায় স্তব্ধ হইয়া আছেন, সেই এক । সেইজন্যই বৈচিত্ৰ্যও সুন্দর এবং বিশ্বকর্মের মধ্যেও বিশ্বব্যাপী শান্তি বিরাজমান। গভীর রাত্রে অনাবৃত আকাশতলে চারি দিককে কী নিভৃত এবং নিজেকে কী একাকী বলিয়া মনে হয়। অথচ তখন আলোকের যবনিকা অপসারিত হইয়া গিয়া হঠাৎ আমরা জানিতে পাই যে, অন্ধকার সভাতলে জ্যোতিষ্কলোকের অনন্ত জনতার মধ্যে আমরা দণ্ডায়মান । এ কী অপরূপ আশ্চর্য ; অনন্ত জগতের নিভৃত নিৰ্জনতা। কত জ্যোতির্ময় এবং কত জ্যোতিহীন মহাসূৰ্য্যমণ্ডল, কত অগণ্য যোজনব্যাপী চক্রপথে ঘূর্ণনৃত্য, কত উদ্দাম বাষ্পসংঘাত, কত ভীষণ অগ্নি-উচ্ছােস- তাহারই মধ্যস্থলে