পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 AO ববীন্দ্র-রচনাবলী জগৎসংসারের সমস্ত দুঃখতাপের সমস্ত তাৎপর্য অখণ্ড মঙ্গলে পরিসমাপ্ত হইয়া আছে। মৃতোঃ স মৃত্যুমাপ্নোতি য ইহ নানেব পশ্যতি | মৃত্যু হইতে সে মৃত্যুকে প্রাপ্ত হয়, যে ইহাকে নানা করিয়া দেখে | খণ্ডতার মধ্যে কদৰ্য্যতা, সৌন্দর্য একের মধ্যে ; খণ্ডতার মধ্যে প্রয়াস, শান্তি একের মধ্যে ; খণ্ডতার মধ্যে বিরোধ, মঙ্গল একের মধ্যে ; তেমনি খণ্ডতার মধ্যেই মৃত্যু, অমৃত সেই একের মধ্যে | সেই এককে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করিয়া দেখিলে, সহস্রের হাত হইতে আপনাকে আর রক্ষা কবিতে পারি না । তবে বিষয় প্রবল হইয়া উঠে, ধন-জন-মান বড়ো আকার ধারণ করিয়া আমাদিগকে ঘুরাইতে থাকে, অশ্বরথ-ইষ্টককাষ্ঠ মর্যাদালাভ করে, দ্রব্যসামগ্ৰী-সংগ্রহচেষ্টার অন্ত থাকে না, প্রতিবেশীর সহিত নিরস্তর প্রতিযোগিতা জাগিয়া উঠে, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কড়াকড়ি-হানাহানির মধ্যে নিজেকে খণ্ড খণ্ড করিতে থাকি, এবং মৃত্যু যখন আমাদের এই ভাণ্ডারদ্বার হইতে আমাদিগকে অকস্মাৎ আকর্ষণ করিয়া লইয়া যায়, তখন সেই শেষ মুহুর্তে সমস্ত জীবনের বহুবিরোধের সঞ্চিত স্তুপাকার দ্রব্যসামগ্ৰীগুলাকেই প্রিয়তম বলিয়া, আত্মার পরম আশ্রয়স্থল বলিয়া, অন্তিমবলে বক্ষে আকর্ষণ করিয়া ধরিতে চাহি । মনসৈবেদমাপ্তব্যং নেহ নানাস্তি কিঞ্চন | মনের দ্বারাই ইহা পাওয়া যায় যে, ইহাতে ‘নানা কিছুই নাই | বিশ্বজগতের মধ্যে যে অপ্রমেয় ধ্রুব রহিয়াছেন, তিনি বাহত একভাবে কোথাও প্রতিভাত নহেনমনই নানার মধ্যে সেই এককে দেখে, সেই এককে প্রার্থনা করে, সেই এককে আশ্রয় করিয়া আপনাকে চরিতাৰ্থ করে । নানার মধ্যে সেই এককে না পাইলে মনের সুখশান্তিমঙ্গল নাই, তাহার উদভ্ৰান্ত-ভ্রমণের অবসান নাই । সে ধ্রুব একের সহিত মন আপনাকে দৃঢ়ভাবে যুক্ত করিতে না পাবিলে, সে অমৃতের সহিত যুক্ত হয় না— সে খণ্ড খণ্ড মৃতু্যদ্বারা আহত তাড়িত বিক্ষিপ্ত হইয় বেড়ায় । মন আপনার স্বাভাবিকধর্মবিশতই কখনো জানিয়া, কখনো না জানিয়া, কখনো বক্রপথে, কখনো সরলপথে, সকল জ্ঞানের মধ্যে – সকল ভাবের মধ্যে অহরহ সেই পরম ঐক্যের পরম আনন্দকে সন্ধান করিয়া ফিরে । যখন পায়, তখন একমুহূর্তেই বলিয়া উঠে। — আমি অমৃতকে পাইয়াছি— বলিয়া উঠে—- বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তমাদিত্যবৰ্ণং তমসঃ পরস্তাৎ | য এতদবিন্দুর মৃত্যস্তে ভবান্তি । অন্ধকারের পরে আমি এই জ্যোতির্ময় মহান পুরুষকে জানিয়াছি । যাহারা ইহাকে জানেন তাহারা অমর २०ों ! পত্নী মৈত্ৰেয়ীকে সমস্ত সম্পত্তি দিয়া যাজ্ঞবল্কা যখন বনে যাইতে উদ্যত হইলেন, তখন মৈত্ৰেয়ী স্বামীকে জিজ্ঞাসা করিলেন--- এ সমস্ত লইয়া আমি কি অমর হইব % যাজ্ঞবল্কা কহিলেন, না, যাহারা উপকরণ লইয়া থাকে, তাহদের যেরূপ, তোমারও সেইরূপ জীবন হইবে । তখন মৈত্ৰেয়ী কহিলেন : যেনাহং নামৃত সাং কিমহং তেন। কুর্যাম ? যাহার দ্বারা আমি অমৃত না হইব, ৩াহা লইয়া আমি কী করিব ? যাহা বহু যাহা বিচ্ছিন্ন, হাহা মৃত্যুর দ্বারা আক্রান্ত, তাহকে পরিত্যাগ করিয়া মৈত্ৰেয়ী অখণ্ড অমৃত একের মধ্যে আশ্রয় প্রার্থনা করিয়াছিলেন । মৃত্যু এই জগতের সহিত, বিচিত্রের সহিত, অনেকের সহিত, আমাদের সম্বন্ধের পরিবর্তন করিয়া দেয়।— কিন্তু সেই একের সহিত আমাদের সম্বন্ধের পরিবর্তন ঘটাইতে পারে না । অতএব যে সাধক সমস্ত অন্তঃকরণের সহিত সেই এককে আশ্রয় করিয়াছেন, তিনি অমৃতকে বরণ করিয়াছেন , তাহার কোনো ক্ষতির ভয় নাই, বিচ্ছেদের আশঙ্কা নাই । তিনি জানেন, জীবনের সুখদুঃখ নিয়ত চঞ্চল, কিন্তু তাহার মধ্যে সেই কল্যাণরূপী এক স্তব্ধ হইয়া রহিয়াছেন, লাভক্ষতি নিত্য আসিতেছে। যাইতেছে, কিন্তু সেই এক পরামলাভ আত্মার মধ্যে স্তব্ধ হইয়া বিরাজ করিতেছেন ; বিপদসম্পদ মুহুর্তে-মুহূর্তে আবর্তিত হইতেছে, কিন্তু— এষাস পরম গতিঃ, এষাস্য পরম সম্পাৎ, এষোহস্য পরমে লোকঃ এষোহস্য পরম আনন্দঃ । সেই এক রহিয়াছেন— যিনি জীবের পরম গতি, যিনি জীবের পরম সম্পৎ, যিনি জীবের পরম লোক, যিনি জীবের পরম আনন্দ |