পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ধর্ম 8. আমার সাব-চেয়ে সত্য ইচ্ছা, নিত্য ইচ্ছা কোনটা ? যে-ইচ্ছা আমার সার্থকতাসাধনে নিরত। আমার সার্থকতা আমার কাছে যতদিন পর্যন্ত রহস্য, সেই ইচ্ছাও ততদিন আমার কাছে গুপ্ত | কিসে আমার পেট ভরিবে, আমার নাম হইবে, তাহা বলা শক্ত নয়— কিন্তু কিসে আমি সম্পূর্ণ হইব, তাহা পথিবীতে কয়জন লোক আবিষ্কার করিতে পারিয়াছে ? আমি কী, আমার মধ্যে যে-একটা প্রকাশচেষ্টা চলিতেছে তাহার পরিণাম কী, তাহার গতি কোন দিকে, তাহা স্পষ্ট করিয়া কে জানে ? অতএব দেবতা যদি বর দিতে আসেন, তবে হঠাৎ দেখি, প্রার্থনা জানাইবার জন্যও প্রস্তুত নই ; তখন এই কথা বলিতে হয়, আমার যথার্থ প্রার্থনা কী, তাহা জানিবার জন্য আমাকে সুদীর্ঘ সময় দাও । নহিলে উপস্থিতমত হঠাৎ একটা-কিছু চাহিতে গিয়া হয়তো ভয়ানক ফাঁকিতে পড়িতে হইবে । বস্তুত আমরা সেই সময় লইয়াছি— আমাদের জীবনটা এই কাজেই আছে । আমরা কী প্রার্থনা করিব, তাহাই অহরহ পরখ করিতেছি । আজ বলিতেছি খেলা, কাল বলিতেছি। ধন, পরদিন বলিতেছি মান- এমনি করিয়া সংসারকে অবিশ্রাম মন্থন করিতেছি- আলোড়ন করিতেছি। কিসের জন্য ? আমি যথাৰ্থ কী চাই, তাহারই সন্ধান পাইবার জন্য। মনে করিতেছি— টাকা খুঁজিতেছি, বন্ধু খুজিতেছি, মান খুঁজতেছি ; কিন্তু আসলে আর-কিছু নয়, কাহাকে যে খুঁজতেছি, তাহাই নানাস্থানে খুঁজিয়া বেড়াইতেছি— আমার প্রার্থনা কী, তাহাই জানি না । যাহারা আপনাদের অন্তরের প্রার্থনা খুঁজিয়া পাইয়াছেন বলেন— শোনা গিয়াছে তাহারা কী বলেন । তাহারা বলেন, একটিমাত্র প্রার্থনা আছে, তাহা এই-- আসতো মা সদগময় তমসো মা জ্যোতিগাময়, মৃতোর্মামৃতং গময় | আবিরাবীর্ম এধি | রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিতাম । অসত্য হইতে আমাকে সত্যে লইয়া যাও, অন্ধকার হইতে আমাকে জ্যোতিতে লইয়া যাও, মৃত্যু হইতে আমাকে অমৃতে লইয়া যাও । হে স্বপ্রকাশ, আমার নিকটে প্রকাশিত হও । রুদ্র, তোমার যে প্রসন্ন মুখ, তাহার দ্বারা আমাকে সর্বদাই বক্ষণ করে। কিন্তু কানে শুনিয়া কোনো ফল নাই এবং মুখে উচ্চারণ করিয়া যাওয়া আরো বৃথা । আমরা যখন সত্যকে আলোককে অমৃতকে যথার্থ চাহিব, সমস্ত জীবনে তাহার পরিচয় দিব, তখনই এ প্রার্থনা সার্থক হইবে । যে প্রার্থনা আমি নিজে মনের মধ্যে পাই নাই, তাহা পূর্ণ হইবার কোনো পথ আমার সম্মুখে নাই । অতএব, সবই শুনিলাম বটে, মন্ত্রও কর্ণগোচর হইল— কিন্তু তবু এখনো প্রার্থনা করিবার বনস্পতি হইয়া উঠিবার একমাত্র প্রার্থনা বীজের শস্যাংশের মধ্যে সংহতভাবে নিগৃঢ়ভাবে নিহিত হইয়া আছে- কিন্তু যতক্ষণ তাহা অঙ্কুরিত হইয়া আকাশে আলোকে মাথা না তুলিয়াছে, ততক্ষণ তাহা না থাকারই তুল্য হইয়া আছে। সত্যের আকাঙক্ষা, অমৃতের আকাঙক্ষা আমাদের সকল আকাঙক্ষার অন্তর্নিহিত, কিন্তু ততক্ষণ আমরা তাহাকে জানিই না, যতক্ষণ না সে আমাদের সমস্ত আমাদের এই যথার্থ প্রার্থনাটি কী, তাহা অনেক সময় অন্যের ভিতর দিয়া আমাদিগকে জানিতে হয় | জগতের মহাপুরুষেরা আমাদিগকে নিজের অন্তৰ্গঢ় ইচ্ছাটিকে জানিবার সহায়তা করেন। আমরা চিরকাল মনে করিয়া আসিতেছি, আমরা বুঝি পেট ভরাইতেই চাই, আরাম করিতেই চাই— কিন্তু যখন দেখি, কেহ ধন-মান আরামকে উপেক্ষা করিয়া সত্য, আলোক ও অমৃতের জন্য জীবন উৎসর্গ করিতেছেন, তখন হঠাৎ একরকম করিয়া বুঝিতে পারি যে, আমার অন্তরাত্মার মধ্যে যে ইচ্ছ। আমার অগোচরে কাজ করিতেছে, তাহাকেই তিনি তাহার জীবনের মধ্যে উপলব্ধি করিয়াছেন। আমার ।