পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ধর্ম 8ዓ Ö হয় না। তখন বুঝিতে পারা যায়, সমস্ত মানবের নিত্য আকাঙক্ষা আমার মধ্যে জাগ্রত হইয়াছে— এই সুমহৎ-আকাঙক্ষাই আপনার মধ্যে আপনার সফলতা অতি সুন্দরভাবে, অতি সহজভাবে বহন করিয়া আনে | - আমাদের ছোটাে বড়ো সকল ইচ্ছাকেই মানবের এই বড়ো ইচ্ছা, এই মর্মগত প্রার্থনা দিয়া যাচাই করিয়া লইতে হইবে। নিশ্চয় বুঝিতে হইবে, আমাদের যে-কোনাে ইচ্ছা এই সত্য-আলোক-অমৃতের ইচ্ছাকে অতিক্রম করে, তাহাই আমাদিগকে খর্ব করে, তাহাঁই, কেবল আমাকে নহে, সমস্ত মানবকে পশ্চাতের দিকে টানিতে থাকে | এ-যে কেবল আমাদের খাওয়া পরা, আমাদের ধনমান-অৰ্জন সম্বন্ধেই খাটে, তাহা নহে-- আমাদের বড়ো বড়ো চেষ্টা সম্বন্ধে আরো বেশি করিয়াই খাটে ! যেমন দেশহিতৈষী । এ-প্রবৃত্তি যদিও আমাদের আত্মত্যাগ ও দুষ্কর তপঃসাধনের দিকে লইয়া যায়, তবু ইহা মানবত্বের গুরুতর অন্তরায়-স্বরূপ হইয়া উঠিতে পারে । ইহার প্রমাণ আমাদের সম্মুখেই, আমাদের নিকটেই রহিয়াছে। যুরোপীয় জাতিরা ইহাকেই তাহদের চরম লক্ষ্য, পরম ধর্ম বলিয়া গ্রহণ করিয়াছে। ইহা প্রতিদিনই সত্যকে, আলোককে, অমৃতকে যুরোপের দৃষ্টি হইতে আড়াল করিতেছে। যুরোপের স্বদেশাসক্তিই মানবত্বলাভের ইচ্ছাকে, সার্থকতালাভের ইচ্ছাকে প্রবলবেগে প্রতিহত করিতেছে এবং যুরোপীয় সভ্যতা অধিকাংশ পৃথিবীর পক্ষে প্রকাণ্ড বিভীষিকা হইয়া উঠিতেছে। যুরোপ কেবলই মাটি চাহিতেছে, সোনা চাহিতেছে, প্ৰভুত্ব চাহিতেছে- এমন লোলুপভাবে, এমন ভীষণভাবে চাহিতেছে যে, সত্য, আলোক ও অমৃতের জন্য মানবের যে চিরন্তন প্রার্থনা তাহা যুরোপের কাছে উত্তরোত্তর প্রচ্ছন্ন হইয়া গিয়া তাহাকে উদ্দাম করিয়া তুলিতেছে। ইহাই বিনাশের পথ- পথ নহে— ইহাই মৃত্যু | আমাদের সম্মুখে, আমাদের অত্যন্ত নিকটে য়ুরোপের এই দৃষ্টান্ত আমাদিগকে প্রতিদিন মোহাভিভূত করিয়া তুলিতেছে। কিন্তু ভারতবর্ষকে এই কথাই কেবল মনে রাখিতে হইবে যে, সত্য-আলোক-অমৃতই প্রার্থনার সামগ্ৰী ; বিষয়ানুরাগই হউক আর দেশানুরাগই হউক, আপনার উদ্দেশ্য বা উদ্দেশ্যসাধনের উপায় যেখানেই এই সত্য, আলোক ও অমৃতকে অতিক্রম করিতে চাহে, সেখানেই তাহাকে অভিশাপ দিয়া বলিতে হইবে— ‘বিনিপাত !’ বলা কঠিন । প্রলোভন প্রবল, ক্ষমতার মোহ অতিক্রম করা অতি দুঃসাধ্য, তবু ভারতবর্ষ এই কথা সুস্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন— অধমেণৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি | ততঃ সপত্নান জয়তি সমূলস্তু বিনশ্যতি | আষাঢ় ১৩১১ ধমপ্রচার "এস আমরা ফললাভ করি বলিয়া হঠাৎ উৎসাহে তখনই পথে বাহির হইয়া পড়াই যে ফললাভের উপায়, তাহা কেহই বলিবেন না । কারণ কেবলমাত্র সদিচ্ছা এবং সদ্যুৎসাহের বলে ফল সৃষ্টি করা যায় না, বীজ হইতে বৃক্ষ এবং বৃক্ষ হইতে ফল জন্মে। দলবদ্ধ উৎসাহের দ্বারাতেও সে-নিয়মের অন্যথা ঘটতে পারে না। বীজ ও বৃক্ষের সহিত সম্পর্ক না রাখিয়া আমরা যদি অন্য উপায়ে ফললাভের আকাঙক্ষা করি, তবে সেই ঘরগড়া কৃত্ৰিম ফল খেলার পক্ষে, গৃহসজ্জার পক্ষে অতি উত্তম হইতে পারে— কিন্তু তাহা আমাদের যথাৰ্থ ক্ষুধানিবৃত্তির পক্ষে অত্যন্ত অনুপযোগী হয়। আমাদের দেশে আধুনিক ধৰ্মসমাজে আমরা এই কথাটা ভাবি না। আমরা মনে করি, দল বাঁধিলেই বুঝি ফল পাওয়া যায় । শেষকালে মনে করি দল বাধাটাই ফল । ক্ষণে ক্ষণে আমাদের উৎসাহ হয়, প্রচার করিতে হইবে । হঠাৎ অনুতাপ হয়, কিছু করিতেছি না । Գ||©չ