পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8obr রবীন্দ্র-রচনাবলী একপার্থে ধর্মকেও একটুখানি স্থান দেওয়া আবশ্যক, নতুবা ভব্যতারক্ষা হয় না, নতুবা ঘরের ছেলেমেয়েদের জীবনে যেটুকু ধর্মের সংস্রব রাখা শোভন, তাহা রাখিবার উপায় থাকে না ; আমরা যে মনে করিব, আমাদের আদর্শভূত পাশ্চাত্যসমাজে ভদ্রপরিবারেরা ধর্মকে যেটুকু পরিমাণে স্বীকার করা ভদ্রতরক্ষার অঙ্গ বলিয়া গণ্য করেন, আমরাও সর্ববিষয়ে তাহাদের অনুবর্তন করিয়া অগত্যা সেইটুকু পরিমাণ ধর্মের ব্যবস্থা না রাখিলে লজ্জার কারণ হইবে ; তবে আমাদের সেই ভদ্রতাবিলাসের আসবাবের সঙ্গে ভারতের সুমহৎ ব্ৰহ্মনামকে জড়িত করিয়া রাখিলে আমাদের পিতামহদের পবিত্রতম সাধনাকে চটুলতম পরিহাসে পরিণত করা হইবে । র্যাহারা ব্ৰহ্মকে সর্বত্র উপলব্ধি করিয়াছিলেন, সেই ঋষিরা কী বলিয়াছিলেন ? তাহারা বলেনঈশাবাস্যমিদং সৰ্ব্বং যৎকিঞ্চি জগত্যাং জগৎ | তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনম | বিশ্বজগতে যাহা-কিছু চলিতেছে, সমস্তকেই ঈশ্বরের দ্বারা আবৃত দেখিতে হইবে— এবং তিনি যাহা দান করিয়াছেন তাহাই ভোগ করিতে হইবে— অন্যের ধনে লোভ করিবে না । ইহার অর্থ এমন নহে যে, ঈশ্বর সর্বব্যাপী এই কথাটা স্বীকার করিয়া লইয়া, তাহার পরে সংসারে যেমন ইচ্ছা, তেমনি করিয়া চলা । যথার্থভাবে ঈশ্বরের দ্বারা সমস্তকে আচ্ছন্ন করিয়া দেখিবার অর্থ অত্যন্ত বৃহৎ- সেরূপ করিয়া না দেখিলে সংসারকে সত্য করিয়া দেখা হয় না এবং জীবনকে অন্ধ করিয়া রাখা হয় । ‘ঈশাবাস্যমিদং সৰ্বম— ইহা কাজের কথা— ইহা কাল্পনিক কিছু নহে— ইহা কেবল শুনিয়া জানার এবং উচ্চারণ দ্বারা মানিয়া লইবার মন্ত্র নহে । গুরুর নিকট এই মন্ত্র গ্রহণ করিয়া লইয়া তাহার পরে দিনে দিনে পদে পদে ইহাকে জীবনের মধ্যে সফল করিতে হইবে ; সংসারকে ক্রমে ক্রমে ঈশ্বরের মধ্যে ব্যাপ্ত করিয়া দেখিতে হইবে । পিতাকে সেই পিতার মধ্যে, মাতাকে সেই মাতার মধ্যে, বন্ধুকে সেই বন্ধুর মধ্যে, প্রতিবেশী, স্বদেশী ও মনুষ্যসমাজকে সেই সর্বভূতান্তরাত্মার মধ্যে উপলব্ধি করিতে হইবে । ঋষিরা যে ব্ৰহ্মকে কতখানি সত্য বলিয়া দেখিয়াছিলেন, তাহা তীহাদের একটি কথাতেই বুঝিতে পারি- তাহারা বলিয়াছেন তেষামেবৈষ ব্ৰহ্মলোকো যেষাং তপো ব্ৰহ্মচৰ্য্যং যেষু সত্যং প্রতিষ্ঠিতম | এই যে ব্ৰহ্মলোক- অর্থাৎ যে ব্ৰহ্মলোক সর্বত্রই রহিয়াছে — ইহা তাহদেরই, তপস্যা র্যাহাদের, ব্ৰহ্মচর্য যাহাদের, সত্য যাহাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত { অর্থাৎ র্যাহারা যথার্থভাবে ইচ্ছা করেন, যথার্থভাবে চেষ্টা করেন, যথার্থ উপায় অবলম্বন করেন । তপস্যা একটা কোনো কৌশলবিশেষ নহে, তাহা কোনো গোপনরহস্য নহে ঋতং তপঃ সত্যং তপঃ শ্রুতং তপঃ শািন্তং তপো দানং তপো যজ্ঞস্তপো ভুর্ভুবঃসুবৰ্ণক্ষৈতদুপসৈাতং তপ: | ঋতুই তপস্যা, সত্যই তপস্যা, শ্রুত তপস্যা, ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ তপস্যা, দান তপস্যা, কর্ম তপস্যা, এবং ভূলোক-ভুবলোক-স্বলোকব্যাপী এই যে ব্ৰহ্ম, ইহার উপাসনাই তপস্যা। অর্থাৎ ব্ৰহ্মচর্যের দ্বারা বল তেজ শান্তি সন্তোষ নিষ্ঠা ও পবিত্ৰতা লাভ করিয়া, দান ও কর্ম দ্বারা স্বাৰ্থপাশ হইতে মুক্তিলাভ করিয়া তবে অন্তরে-বাহিরে আত্মীয়-পরে লোক-লোকান্তরে ব্ৰহ্মকে লাভ করা যায় । উপনিষদ বলেন, যিনি ব্ৰহ্মকে জানিয়াছেন, তিনি মেবাবিবেশ, সকলের মধ্যে প্রবেশ করেন । বিশ্ব হইতে আমরা যে পরিমাণে বিমুখ হই, ব্ৰহ্ম হইতেই আমরা সেই পরিমাণে বিমুখ হইতে থাকি । আমরা ধৈৰ্যলাভ করিলাম কি না, অভয়লাভ করিলাম কি না, ক্ষমা আমাদের পক্ষে সহজ হইল কি না, আত্মবিস্মৃত মঙ্গলভােব আমাদের পক্ষে স্বাভাবিক হইল কি না, পরনিন্দা আমাদের পক্ষে অপ্রিয় ও