পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8b-○ রবীন্দ্র-রচনাবলী পীড়িত হইতে না দিই। ব্ৰহ্ম ধন্য- তিনি সর্বদেশে, সর্বকালে, সর্বজীবে ধন্য- তিনি কোনো দলের নহেন, কোনো সমাজের নহেন, কোনো বিশেষ ধর্মপ্রণালীর নহেন, তাহাকে লইয়া ধর্মের বিষয়কর্ম ফাদিয়া বসা চলে না। ব্ৰহ্মচারী শিষ্য জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন– “স ভগবঃ কস্মিন প্রতিষ্ঠিত ইতি’- “হে ভগবন, তিনি কোথায় প্রতিষ্ঠিত আছেন ?? ব্ৰহ্মবাদী গুরু উত্তর করিলেন— ‘স্বে মহিন্নি’- “আপন মহিমাতে ।” তাহারই সেই মহিমার মধ্যে র্তাহার প্রতিষ্ঠা অনুভব করিতে হইবে- আমাদের রচনার মধ্যে নহে | ফায়ুন ১৩১০ محے বিষশেষ পুরাতন বর্ষের সূর্য পশ্চিম প্রান্তরের প্রান্তে নিঃশব্দে অস্তমিত হইল। যে কয়বৎসর পৃথিবীতে কাটাইলাম। অদ্য তাহারই বিদায়যাত্রার নিঃশব্দ। পক্ষধ্বনি এই নির্বাণালোকে নিস্তব্ধ আকাশের মধ্যে যেন ভুকুৰিতেছ। সে অজ্ঞাত সম্পারগামী পক্ষীর মতাে কােথায় চলিয়া গেল তাঙ্কর আর কােন Şश्रु काट्ने । হে চিরদিনের চিরন্তন, অতীত জীবনকে এই যে আজ বিদায় দিতেছি। এই বিদায়কে তুমি সার্থক করো— আশ্বাস দাও যে, যাহা নষ্ট হইল বলিয়া শোক করিতেছি তাহার সকলই যথাকলে তোমার মধ্যে সফল হইতেছে | আজি যে প্রশান্ত বিষাদ সমস্ত সন্ধ্যাকাশকে আচ্ছন্ন করিয়া আমাদের হৃদয়কে আবৃত করিতেছে, তাহা সুন্দর হউক, মধুময় হউক, তাহার মধ্যে অবসাদের ছায়ামাত্র না পড়ক । আজ বর্ষাবসানের অবসানদিনে বিগত জীবনের উদ্দেশে আমাদের ঋষি পিতামহদিগের আনন্দময় মৃত্যুমন্ত্র উচ্চারণ করি । ওঁ মধু বাতা ঋতীয়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ। মাধবীর্নঃ সন্তোষধীঃ । মধু নক্তম উতোষসে মধুমৎ পার্থিবং রজঃ । মধুমান্নো বনস্পতির্মধূমাং অস্তু সূৰ্যঃ ! ওঁ । বায়ু মধু বহন করিতেছে। নদী সিন্ধু সকল মধুক্ষরণ করিতেছে। ওষধী বনস্পতি সকল মধুময় হউক রাত্ৰি মধু হউক, উষা মধু হউক, পৃথিবীর ধূলি মধুমৎ হউক । সূর্য মধুমান হউক । রাত্রি যেমন আগামী দিবসকে নবীন করে, নিদ্রা যেমন আগামী জাগরণকে উজ্জ্বল করে, তেমনি আদ্যকার বর্ষাবসান যে গত জীবনের স্মৃতির বেদনাকে সন্ধ্যার ঝিল্লীঝংকারসুপ্ত অন্ধকারের মতো হৃদয়ের মধ্যে ব্যাপ্ত করিয়া দিতেছে, তাহা যেন নববর্ষের প্রভাতের জন্য আমাদের আগামী বৎসরের আশামুকুলকে লালন করিয়া বিকশিত করিয়া তুলে। যাহা যায় তাহা যেন শূন্যতা রাখিয়া যায় না, তাহ যেন পূর্ণতার জন্য স্থান করিয়া যায়। যে বেদনা হৃদয়কে অধিকার করে তাহা যেন নব আনন্দকে জন্ম দিবার বেদনা হয় । যে বিষাদ ধ্যানের পূর্বাভাস, যে শান্তি মঙ্গলকর্মনিষ্ঠার জননী, যে বৈরাগ্য উদার প্রেমের অবলম্বন, যে নির্মল শোক তোমার নিকটে আত্মসমর্পণের মন্ত্রগুরু তাঁহাই আজিকার আসন্ন রজনীর অগ্রগামী হইয়া আমাদিগকে সন্ধ্যাদীপোজ্জ্বল গৃহ-প্রত্যাগত শ্ৰান্ত বালকের মতো অঞ্চলের মধ্যে আবৃত করিয়া লাউক । পৃথিবীতে সকল বস্তুই আসিতেছে এবং যাইতেছে- কিছুই স্থির নহে; সকলই চঞ্চল— বর্ষশেষের সন্ধ্যায় এই কথাই তপ্ত দীর্ঘনিশ্বাসের সহিত হৃদয়ের মধ্যে প্রবাহিত হইতে থাকে । কিন্তু যাহা আছে, যাহা চিরকাল স্থির থাকে, যাহাকে কেহই হরণ করিতে পারে না, যাহা আমাদের অন্তরের অন্তরে বিরাজমান— গত বর্ষে সেই ধুবের কি কোনো পরিচয় পাই নাই— জীবনে কি তাহার কোনাে লক্ষণ