পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8br8 রবীন্দ্র-রচনাবলী পঙ্কের মধ্যে ফেলিয়া দিয়াছি। অদ্য বৎসরের অনুদঘাটিত প্রথম মুকুল সূর্যের আলোকে মাথা তুলিয়াছে ইহাকে আমরা খণ্ডিত করিব না, সৌন্দর্যে সীেগন্ধ্যে শুভ্রতায় ইহাকে সম্পূর্ণ করিয়া তুলিব । তাহা কখনোই অসাধ্য নহে- সে শক্তি আমাদের মধ্যে আছে নাত্মানমবমনোেত নিজেকে অপমান অবজ্ঞা করিয়ো না । ন হ্যািত্মপরিভৃতিস্য ভূতির্ভবতি শোভনা। আপনাকে যে ব্যক্তি দীন বলিয়া অবমান করে তাহার কখনোই শোভন ঐশ্বর্য লাভ হয় না । ধর্মের যে আদর্শ সর্বশ্রেষ্ঠ, যে আদর্শে ব্রহ্মের জ্যোতি বিশুদ্ধভাবে প্রতিফলিত হয়, তাহা কল্পনাগম্য, অসাধ্য নহে, তাহা রক্ষা করিবার তেজ আমাদের মধ্যে আছে ; নিজেকে জাগ্রত রাখিবার শক্তি আমাদের আছে— এবং জাগ্রত থাকিলে অন্যায় অসত্য হিংসা ঈর্ষা প্রলোভন দ্বারের নিকটে আসিয়া দূরে চলিয়া যায়। আমরা ভয় ত্যাগ করিতে পারি, হীনতা পরিহার করিতে পারি, আমরা প্ৰাণ বিসর্জন করিতে পারি- এ ক্ষমতা আমাদের প্রত্যেকের আছে । কেবল দীনতায় সেই শক্তিকে অবিশ্বাস করি বলিয়া তাহাকে ব্যবহার করিতে পারি না। সেই শক্তি আমাদিগকে কী ভূমানন্দে, কী চরম সার্থকতায় লইয়া যাইতে পারে তাহা জানি না বলিয়াই আত্মার সেই শক্তিকে আমরা স্বার্থে এবং ব্যৰ্থ চেষ্টায় এবং পাপের আয়োজনে নিযুক্ত করি । মনে করি অর্থলাভেই আমাদের চরম সুখ, বাসনা তৃপ্তিতেই আমাদের পরমানন্দ, ইচ্ছার বাধা মোচনেই আমাদের পরম মুক্তি। আমাদের যে-শক্তি চারি দিকে বিক্ষিপ্ত হইয়া আছে তাহাকে একাগ্ৰধারায় ব্রহ্মের দিকে প্রবাহিত করিয়া দিলে জীবনের কর্ম সহজ হয়, সুখদুঃখ সহজ হয়, মৃত্যু সহজ হয় । সেই শক্তি আমাদিগকে বর্ষার স্রোতের মতো অনায়াসেই বহন করিয়া লইয়া যায় ; দুঃখশোক বিপদ-আপদ বাধাবিঘ্ন, তাহার পথের সম্মুখে শরবনের মতো মাথা নত করিয়া দেয়, তাহাকে প্রতিহত করিতে পারে না | পুনর্বাের বলিতেছি, এই শক্তি আমাদের মধ্যে আছে। কেবল, চারি দিকে ছড়াইয়া আছে বলিয়াই তাহার উপর নিজের সমস্ত ভার সমপণ করিয়া গতিলাভ করিতে পারি না । নিজেকে প্রত্যহ নিজেই বহন করিতে হয় | প্ৰত্যেক কাজ আমাদের স্কন্ধের উপর আসিয়া পড়ে ; প্রত্যেক কাজের আশানৈরাশ্য-লাভক্ষতির সমস্ত ঋণ নিজেকে শেষ কড়া পর্যন্ত শোধ করিতে হয় । স্রোতের উপর যেমন মাঝির নীেকা থাকে এবং নীেকার উপরেই তাহার সমস্ত বোঝা থাকে তেমনি ব্ৰহ্মের প্রতি যাহার চিত্ত একাগ্রভাবে ধাবমান, তাহার সমস্ত সংসার এই পরিপূর্ণ ভাবের স্রোতে ভাসিয়া চলিয়া যায় এবং কোনো বোঝা তাহার স্কন্ধকে পীড়িত করে না । নববর্ষের প্রাতঃসূর্যালোকে দাড়াইয়া অদ্য আমাদের হৃদয়কে চার দিক হইতে আহবান করি } ভারতবর্ষের যে পৈতৃক মঙ্গলশঙ্খ গৃহের প্রান্তে উপেক্ষিত হইয়া পড়িয়া আছে সমস্ত প্ৰাণের নিশ্বাস তাহাতে পরিপূর্ণ করি— সেই মধুর গভীর শঙ্খধ্বনি শুনিলে আমাদের বিক্ষিপ্ত চিত্ত অহংকার হইতে, স্বাৰ্থ হইতে, বিলাস হইতে, প্রলোভন হইতে ছুটিয়া আসিবে । আজ শতধারা একধারা হইয়া গোমুখীর মুখনিঃসৃত সমুদ্রবাহিনী গঙ্গার ন্যায় প্রবাহিত হইবে- তাহা হইলে মুহূর্তের মধ্যে প্রান্তরশায়ী এই নির্জন তীর্থ যথার্থই হরিদ্বার তীর্থ হইয়া উঠিবে। হে ব্ৰহ্মাণ্ডপতি, অদ্য নববর্ষের প্রভাতে তোমার জ্যোতিঃস্নাত তরুণ সূর্য পুরোহিত হইয়া নিঃশব্দে আমাদের আলোকের অভিষেক সম্পন্ন করিল । আমাদের ললাটে আলোক স্পর্শ করিয়াছে | আমাদের দুই চক্ষু আলোকে ধৌত হইয়াছে। আমাদের পথ আলোকে রঞ্জিত হইয়াছে। আমাদের সদ্যোজাগ্রত হৃদয় ব্ৰতগ্রহণের জন্য তোমার সম্মুখে উপবিষ্ট হইয়াছে। যে শরীরকে অদ্য তোমার সমীরণ স্পর্শ করিল তাহাকে যেন প্রতিদিন পবিত্র রাখিয়া তোমার কর্মে নিযুক্ত করি । যে মস্তকে তোমার প্রভাতকিরণ বর্ষিত হইল সে মস্তককে ভয় লজ্জা ও হীনতার অবনতি হইতে রক্ষা করিয়া তোমারই পূজায় প্রণত করি । তোমার নামগানধারা আজ প্রত্যুষে যে হৃদয়কে পুণ্যবারিতে স্নান করাইল, সে যেন আনন্দে পাপকে পরিহার করিতে পারে, আনন্দে তোমার কল্যাণকৰ্মে জীবনকে উৎসর্গ করিতে