পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ヶど রবীন্দ্র-রচনাবলী না— যেদিন প্রাকৃতিক নিয়মপরম্পরার হস্তে আপনাদিগকে ক্ৰীড়াপুত্তলির মতো ক্ষুদ্র ও জড়ভাবে অনুভব করি, সেদিন আমাদের উৎসবের দিন নহে ; সেদিন তো আমরা জড়ের মতো উদ্ভিদের মতো সাধারণ জন্তুর মতো-সেদিন তো আমরা আমাদের নিজের মধ্যে সর্বজয়ী মানবশক্তি উপলব্ধি কৱি না— সেদিন আমাদের আনন্দ কিসের ? সেদিন আমরা গৃহে অবরুদ্ধ, সেদিন আমরা কর্মে ক্লিষ্ট-সেদিন আমরা উজ্জ্বলভাবে আপনাকে ভূষিত করি না—সেদিন আমরা উদারভাবে কাহাকেও আহবান করি না— সেদিন আমাদের ঘরে সংসার চক্রের ঘর্ঘর-ধ্বনি শোনা যায়, কিন্তু সংগীত শোনা शीश eों | প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী— কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ । হে ভ্রাতৃগণ, আজ আমি তোমাদের সকলকে ভাই বলিয়া সম্ভাষণ করিতেছি—আজ, আলোক জুলিয়াছে, সংগীত ধ্বনিতেছে, দ্বার খুলিয়াছে— আজি মনুষ্যত্বের গৌরব আমাদিগকে স্পর্শ করিয়াছে— ‘আজ আমরা কেহ একাকী নহি— আজ আমরা সকলে মিলিয়া এক— আজি অতীত সহস্ৰ বৎসরের অমৃতবাণী আমাদের কর্ণে ধ্বনিত হইতেছে— আজ অনাগত সহস্ৰ বৎসর আমাদের কণ্ঠস্বরকে বহন করিবার জন্য সম্মুখে প্রতীক্ষা করিয়া আছে। আজ আমাদের কিসের উৎসব ? শক্তির উৎসব । মানুষের মধ্যে কী আশ্চৰ্যশক্তি আশ্চর্যরূপে প্রকাশ পাইতেছে! আপনার সমস্ত ক্ষুদ্র প্রয়োজনকে অতিক্রম করিয়া মানুষ কোন উর্ধের্ব গিয়া দাড়াইয়াছে। জ্ঞানী জ্ঞানের কোন দুর্লক্ষ্য দুৰ্গমতার মধ্যে ধাবমান হইয়াছে, প্রেমিক প্রেমের কোন পরিপূর্ণ আত্মবিসর্জনের মধ্যে গিয়া উত্তীর্ণ হইয়াছে, কমী কর্মের কোন অশ্রান্ত দুঃসাধ্য সাধনের মধ্যে অকুতোভয়ে প্রবেশ করিয়াছে ? জ্ঞানে প্রেমে কর্মে মানুষ যে অপরিমেয় শক্তিকে প্রকাশ করিয়াছে, আজ আমরা সেই শক্তির গৌরব স্মরণ করিয়া উৎসব করিব | আজ আমরা আপনাকে, ব্যক্তিবিশেষ নহে, কিন্তু মানুষ বলিয়া জানিয়া ধন্য হইব । মানুষের সমস্ত প্রয়োজনকে দুরূহ করিয়া দিয়া ঈশ্বর মানুষের গৌরব বাড়াইয়াছেন। পশুর জন্য মাঠ ভরিয়া তৃণ পড়িয়া আছে, মানুষকে অন্নের জন্য প্রাণপণ করিয়া মরিতে হয়। প্রতিদিন আমরা যে অন্নগ্ৰহণ করিতেছি, তাহার পশ্চাতে মানুষের বুদ্ধি মানুষের উদ্যম মানুষের উদযোগ রহিয়াছে— আমাদের অন্নমুষ্টি আমাদের গৌরব । পশুর গাত্রবস্ত্রের অভাব একদিনের জন্যও নাই, মানুষ উলঙ্গ হইয়া জন্মগ্রহণ করে । শক্তির দ্বারা আপন অভাবকে জয় করিয়া মানুষকে আপন অঙ্গ আচ্ছাদন করিতে হইয়াছে— গাত্রবস্ত্ৰ মনুষ্যত্বের গৌরব | আত্মরক্ষার উপায় সঙ্গে লইয়া মানুষ ভূমিষ্ঠ হয় নাই, আপন শক্তির দ্বারা তাহাকে আপনি অস্ত্ৰ নিৰ্মাণ করিতে হইয়াছে— কোমল ত্বক এবং দুর্বল শরীর লইয়া মানুষ যে আজ সমস্ত প্ৰণিসমাজের মধ্যে আপনাকে জয়ী করিয়াছে, ইহা মানবশক্তির গৌরব | মানুষকে দুঃখ দিয়া ঈশ্বর মানুষকে সার্থক করিয়াছেন— তাহাকে নিজের পূর্ণশক্তি অনুভব করিবার অধিকারী করিয়াছেন । মানুষের এই শক্তি যদি নিজের প্রয়োজন সাধনের সীমার মধ্যেই সার্থকতা লাভ করিত, তাহা হইলেও আমাদের পক্ষে যথেষ্ট হইত, তাহা হইলেও আমরা জগতের সমস্ত জীবের উপরে আপনার শ্রেষ্ঠত্ব স্থাপন করিতে পারিতাম। কিন্তু আমাদের শক্তির মধ্যে কোন মহাসমুদ্র হইতে এ কী জোয়ার আসিয়াছে- সে আমাদের সমস্ত অভাবের কুল ছাপাইয়া সমস্ত প্রয়োজনকে লঙ্ঘন করিয়া অহৰ্নিশি অক্লান্ত উদ্যমের সহিত এ কোন অসীমের রাজ্যে কোন অনির্বচনীয় আনন্দের অভিমুখে ধাবমান হইয়াছে। যাহাকে জানিবার জন্য সমস্ত পরিত্যাগ করিতেছে, তাহাকে জানিবার ইহার কী প্রয়োজন । যাহার নিকট আত্মসমৰ্পণ করিবার জন্য ইহার সমস্ত অন্তরাত্মা ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছে তাহার সহিত ইহার আবশ্যকের সম্বন্ধ কোথায় । যাহার কর্ম করিবার জন্য এ আপনার আরাম, স্বার্থ, এমন-কি, প্রাণকে পর্যন্ত তুচ্ছ করিতেছে, তাহার সঙ্গে ইহার দেনাপাওনার হিসাব লেখা থাকিতেছে। কই | আশ্চর্য । ইহাই আশ্চর্য। আনন্দ । ইহাই আনন্দ । যেখানটা মানুষের সমস্ত আবশ্যকসীমার বাহিরে