পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ধর্ম 3 br চলিয়া গেছে, সেইখানেই মানুষের গভীরতম সর্বোচ্চতম শক্তি সর্বদাই আপনাকে স্বাধীন আনন্দে উধাও করিয়া দিবার চেষ্টা করিতেছে। জগতের আর কোথাও ইহার কোনাে তুলনা দেখি না। মনুষ্যশক্তির এই প্রয়োজনাতীত পরম গীেরব আদ্যকার উৎসবে আনন্দসংগীতে ধ্বনিত হইতেছে। এই শক্তি অভাবের উপরে জয়ী, ভয়শোকের উপরে জয়ী, মৃত্যুর উপরে জয়ী। আজ অতীত-ভবিষ্যতের সুমহান মানবলোকের দিকে দৃষ্টিস্থাপনপূর্বক মানবাত্মার মধ্যে এই অভ্ৰভেদী চিরন্তনশক্তিকে প্রত্যক্ষ করিয়া আপনাকে সার্থক করিব | একদা কত সহস্ৰ-বৎসর পূর্বে মানুষ এই কথা বলিয়াছে— বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তম আদিত্যবৰ্ণং তমসঃ পরস্তাৎ ৷ আমি সেই মহান পুরুষকে জানিয়াছি, যিনি জ্যোতির্ময়, যিনি অন্ধকারের পরপরবর্তী । এই প্রত্যক্ষ পৃথিবীতে ইহাই আমাদের জানা আবশ্যক যে, কোথায় আমাদের খাদ্য, কোথায় আমাদের খাদক, কোথায় আমাদের আরাম, কোথায় আমাদের ব্যাঘাত- কিন্তু এই সমস্ত জানাকে বহুদূর পশ্চাতে ফেলিয়া মানুষ চিররহস্য অন্ধকারের এ কোন পরপারে, এ কোন জ্যোতিলোকে কিসের প্রত্যাশায় চলিয়া গৈছে | মানুষ এই যে তাহার সমস্ত প্রত্যক্ষ প্রয়োজনের অভ্যন্তরেও সেই তিমিরাতীত জ্যোতির্ময় মহান পুরুষকে জানিয়াছে, আজ আমরা মানুষের সেই আশ্চর্য জ্ঞানের গৌরব লইয়া উৎসব করিতে বসিয়াছি । যে জ্ঞানের শক্তি কোনো সংকীর্ণতা কোনো নিত্যনৈমিত্তিক আবশ্যকের মধ্যে বদ্ধ থাকিতে চাহে না, যে জ্ঞানের শক্তি কেবলমাত্র মুক্তির আনন্দ উপলব্ধি করিবার জন্য সীমাহীনের মধ্যে পরম সাহসের সহিত আপন পক্ষ বিস্তার করিয়া দেয়, যে তেজসী জ্ঞান আপন শক্তিকে কোনো প্রয়োজনসাধনের উপায়ারূপে নহে, পরস্তু চরমশক্তিরূপেই অনুভব করিবার জন্য অগ্রসর— মনুষ্যত্বের মধ্যে আদা আমরা সেই জ্ঞান সেই শক্তিকে স্পর্শ করিয়া কৃতাৰ্থ হইব । কত-সহস্ৰ বৎসর পূর্বে মানুষ একদা এই কথা উচ্চারণ করিয়াছে— আনন্দং ব্ৰহ্মণো বিদ্বান ন বিভেতি কৃতশ্চন | ব্ৰহ্মের আনন্দ যিনি জানিয়াছেন, তিনি কিছু হইতেই ভয় পান না । এই পৃথিবীতে যেখানে প্রবল দুর্বলকে পীড়ন করিতেছে, যেখানে ব্যাধি-বিচ্ছেদ-মৃত্যু প্রতিদিনের ঘটনা, বিপদ যেখানে অদৃশ্য থাকিয়া প্রতি পদক্ষেপে আমাদের প্রতীক্ষা করে এবং প্রতিকারের উপায় যেখানে অধিকাংশস্থলে আমাদের আয়ত্তাধীন নহে, সেখানে মানুষ সমস্ত প্রাকৃতিক নিয়মের উর্ধে মস্তক তুলিয়া এ কী কথা বলিয়াছে যে, আনন্দং ব্ৰহ্মণো বিদ্বান ন বিভৌতি কৃতশ্চন ! আজি আমরা দুর্বল মানুষের মুখের এই প্রবল অভয়বাণী লইয়া উৎসব করিতে বসিয়াছি ; সহস্রশীর্ষ ভয়ের কারাল কবলের সম্মুখে দাড়াইয়া যে মানুষ অকুষ্ঠিতচিত্তে বলিতে পারিয়াছে, ব্ৰহ্ম আছেন, ভয় নাই—অদ্য আপনাকে সেই মানুষের অন্তর্গত জানিয়া গৌরব লাভ করিব । বহুসহস্রবৎসর পূর্বের উচ্চারিত এই বাণী আজিও ধ্বনিত হইতেছে— তদেতৎ প্ৰেয়ঃ পুত্ৰং প্রেয়ো বিত্তাৎ প্রেয়োহন্যস্মাৎ সর্বস্মাৎ অন্তরতর যদীয়মাত্মা । অন্তরতর এই যে আত্মা, ইনি এই পত্র হইতে প্রিয়, বিত্ত হইতে প্রিয়, অন্য সমস্ত হইতেই প্ৰিয় । ংসারের সমস্ত স্নেহ প্রেমের সামগ্রীর মধ্যে মানুষের যে প্রেম সম্পূর্ণ তৃপ্ত হয় নাই, সংসারের সমস্ত প্রিয়পদার্থের অন্তরে তাহার অন্তরতর যে প্ৰিয়তম, যিনি সমস্ত আত্মীয়পরের অন্তরতর, যিনি সমস্ত দুর-নিকটের অন্তরতম তাহার প্রতি যে প্রেম এমন প্রবল আবেগে এমন অসংশয়ে আকৃষ্ট হইয়াছে— আমরা জানি, মানুষের যে পরমতম প্ৰেম আপনার সমস্ত প্রিয়সামগ্ৰীকে এক মুহুর্তে বিসর্জন দিতে উদ্যত হয়, মানুষের সেই পরমাশ্চর্য প্ৰেমশক্তির গৌরব অদ্য আমরা উপলব্ধি করিয়া উৎসব করিতে সমাগত হইয়াছি । সন্তানের জন্য আমরা মানুষকে দুঃসাধ্যকর্মে প্রবৃত্ত হইতে দেখিয়াছি, অনেক জন্তুকেও সেরূপ দেখিয়াছি— স্বদেশীয়-স্বদলের জন্যও আমরা মানুষকে দুরূহ চেষ্টা প্রয়োগ করিতে দেখিয়াছি— পিপীলিকাকেও মধুমক্ষিককেও সেরূপ দেখিয়ছি। কিন্তু মানুষের কর্ম যেখানে আপনাকে, আপনার