পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ধর্ম 8br、 শ্ৰেষ্ঠতমের সহিত এক গৌরবের বন্ধনে মিলিত করিয়াছে। আজ আমরা মানুষের এই-সকল অবারিত সাধারণসম্পদের সমান অধিকারের সূত্রে ভাই হইয়াছি— আজি মনুষ্যত্বের মাতৃশিলায় আমাদের তৃসম্মিলন । ঈশ্বরের শক্তিবিকাশকে আমরা প্ৰভাতের জোতিরুন্মেষের মধ্যে দেখিয়াছি, ফায়ুনের পুষ্পপর্যাপ্তির মধ্যে দেখিয়াছি, মহাসমুদ্রের নীলাম্বনৃত্যের মধ্যে দেখিয়াছি, কিন্তু সমগ্ৰ মানবের মধ্যে যেদিন তাহার বিরাট বিকাশ দেখিতে সমাগত হই, সেইদিন আমাদের মহামহােৎসব | মনুষ্যত্বের মধ্যে ঈশ্বরের মহিমা যে শত শত অভ্ৰভেদী শিখরমালায় জাগ্রত-বিরাজিত সেখানে সেই উক্তৃঙ্গ শৈল্যাশ্রমে আমরা মানবীমাহান্ত্রোর ঈশ্বরকে মানবসংঘের মধ্যে বসিয়া পূজা করিতে আসিয়াছি। আমাদের ভারতবর্ষে সমস্ত উৎসবই এই মহান ভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত, এ কথা আমরা প্রতিদিন ভুলিতে বসিয়াছি। আমাদের জীবনের যে-সমস্ত ঘটনাকে উৎসবের ঘটনা করিয়াছি, তাহার প্রত্যেকটাতেই আমরা বিশ্বমানবের গৌরব অর্পণ করিতে চেষ্টা করিয়াছি । জন্মোৎসব হইতে শ্ৰাদ্ধানুষ্ঠান পর্যন্ত কোনোটাকেই আমরা ব্যক্তিগত ঘটনার ক্ষুদ্রতার মধ্যে বদ্ধ করিয়া রাখি নাই | এই সকল উৎসবে আমরা সংকীর্ণতা বিসর্জন দিই— সেদিন আমাদের গৃহের দ্বার একেবারে উন্মুক্ত হইয়া যায়, কেবল আত্মীয়স্বজনের জন্য নহে, কেবল বন্ধুবান্ধবের জন্য নহে, রবাহত-অনাহতের জন্য । পুত্ৰ যে জন্মগ্রহণ করে, সে আমার ঘরে নহে, সমস্ত মানুষের ঘরে । সমস্ত মানুষের গৌরবের অধিকারী হইয়া সে জন্মগ্রহণ করে । তাহার জন্ম-মঙ্গলের আনন্দে সমস্ত মানুষকে আহবান করিব না % সে যদি শুদ্ধমাত্র আমার ঘরে ভূমিষ্ঠ হইত, তবে তাহার মতো দীনহীন জগতে আর কে থাকিত । সমস্ত মানুষ যে তাহার জন্য অন্ন বস্ত্র আবাস ভাষা জ্ঞান ধর্ম প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছে। মানুষের অন্তরস্থিত সেই নিতাচেতন মঙ্গলশক্তির ক্রেগড়ে জন্মগ্রহণ করিয়া সে যে এক মুহূর্তে ধন্য হইয়াছে । তাহার জন্ম উপলক্ষে একদিন গৃহের সমস্ত দ্বার খুলিয়া দিয়া যদি সমস্ত মানুষকে স্মরণ না করি, তবে কবে করিব । অন্য সমাজ যাহাকে গৃহের ঘটনা করিয়াছে, ভারতসমাজ তাহাকে জগতের ঘটনা করিয়াছে ; এবং এই জগতের ঘটনাই জগদীশ্বরের পূর্ণমঙ্গল আবির্ভােব প্রত্যক্ষ করিবার যথার্থ অবকাশ। বিবাহব্যাপারকেও মানবসমাজের এক-একটি স্তম্ভস্বরূপ জানিয়া ভারতবর্ষ তাহা সমস্ত মানবের ব্যাপার করিয়া তুলিয়াছে— এই উৎসবেও ভারতের গৃহস্থ সমস্ত মনুষ্যকে অতিথিরূপে গৃহে অভ্যর্থনা করে— তাহা করিলেই যথার্থভাবে ঈশ্বরকে গৃহে আবাহন করা হয়— শুদ্ধমাত্র ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ করিলেই হয় না | এইরূপে গৃহের প্রত্যেক বিশেষ ঘটনায় আমরা এক-একদিন গৃহকে ভুলিয়া সমস্ত মানবের সহিত মিলিত হই এবং সেইদিন সমস্ত মানবের মধ্যে ঈশ্বরের সহিত আমাদের মিলনের দিন । হায়, এখন আমরা আমাদের উৎসবকে প্রতিদিন সংকীর্ণ করিয়া আনিতেছি। এতকালে যাহা বিনয়রসাধুত মঙ্গলের ব্যাপার ছিল, এখন তাহা ঐশ্বৰ্যমন্দােদ্ধত আড়ম্বরে পরিণত হইয়াছে। এখন আমাদের হৃদয় সংকুচিত, আমাদের দ্বার করুদ্ধ। এখন কেবল বন্ধুবান্ধব এবং ধ্বনিমানী ছাড়া মঙ্গলকার্মের দিনে আমাদের ঘরে আর কাহারো স্থান হয় না । আজ আমরা মানবসাধারণকে দূর করিয়া নিজেকে বিচ্ছিন্ন-ক্ষুদ্র করিয়া, ঈশ্বরের বাধাহীন পবিত্রপ্রকাশ হইতে বঞ্চিত করিয়া বড়ো হইলাম বলিয়া কল্পনা করি। আজ আমাদের দীপালোক উজ্জলতর খাদ্য প্রচুরতর আয়োজন বিচিত্ৰতর হইয়াছে— কিন্তু মঙ্গলময় অন্তর্যামী দেখিতেছেন আমাদের শুষ্কতা আমাদের দীনতা আমাদের নির্লজ্জ কৃপণতা । আড়ম্বর দিনে দিনে যতই বাড়িতেছে, ততই এই দীপালোকে এই গৃহসজ্জায় এই রসলেশশূন্য কৃত্রিমতার মধ্যে সেই শান্তমঙ্গলস্বরূপের প্রশান্ত-প্ৰসন্নমুখচ্ছবি আমাদের মদান্ধি দৃষ্টিপথ হইতে আচ্ছন্ন হইয়া যাইতেছে। এখন আমরা কেবল আপনাকেই দেখিতেছি, আপনার স্বর্ণরৌপ্যের চাকচিক্য দেখাইতেছি, আপনার নাম শুনিতেছি ও শুনাইতেছি । হে ঈশ্বর, তুমি আজ আমাদিগকে আহবান করো। বৃহৎ মনুষ্যত্বের মধ্যে আহবান করো। আজ উৎসবের দিন শুদ্ধমাত্র ভােবরসসম্ভোগের দিন নহে, শুদ্ধমাত্র মাধুর্যের মধ্যে নিমগ্ন হইবার দিন নহে— @