পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ܮ ܬ8 সংগীতকে, এই জলের ধারা কেমন করিয়া এত গভীরভাবে ব্যক্তি করিতেছে। এ তো কেবলমাত্র জল ও মাটি- মৃৎপিণ্ডো জলরেখয়া বলয়িতঃ”— কিন্তু যাহা প্রকাশ হইয়া উঠিতেছে তাহা কী। তাঁহাই আনন্দরূপমমৃতম, তাহাই আনন্দের অমৃতরূপ । আবার কালবৈশাখীর প্রচণ্ড ঝড়েও এই নদীকে দেখিয়াছি। বালি উড়িয়া সূর্যাস্তের রক্তচ্ছটাকে পাণ্ডুবৰ্ণ করিয়া তুলিয়াছে, কশাহত কলোঘোড়ার মসৃণ চর্মের মতো নদীর জল রহিয়া রহিয়া কাপিয়া কঁপিয়া উঠিতেছে, পরপারের স্তব্ধ তরুশ্রেণীর উপরকার আকাশে একটা নিঃস্পন্দ আতঙ্কের বিবর্ণিত ফুটিয়া উঠিয়াছে ; তার পর সেই জলস্থল-আকাশের জালের মাঝখানে নিজের ছিন্নবিচ্ছিন্ন মেঘমধ্যে জড়িত আবর্তিত হইয়া উন্মত্ত ঝড় একেবারে দিশেহারা হইয়া আসিয়া পড়িল, সেই আবির্ভাব দেখিয়াছি। তাহা কি কেবল মেঘ এবং বাতাস, ধুলা এবং বালি, জল এবং ডাঙ ? এই সমস্ত অকিঞ্চিৎকারের মধ্যে এ যে অপরূপের দর্শন । এই তো রস । ইহা তো শুধু বীণার কাঠ ও তার নােহ, ইহাই বীণার সংগীত। এই সংগীতেই আনন্দের পরিচয় সেই আনন্দরূপমমৃতম | আবার মানুষের মধ্যে যাহা দেখিয়াছি তাহা মানুষকে কতদূরেই ছাড়াইয়া গেছে। রহস্যের অন্ত পাই নাই । শক্তি এবং প্রীতি কত লোকের এবং কত জাতির ইতিহাসে কত আশ্চর্য আকার ধরিয়া কত অচিন্তা ঘটনা ও কত অসাধ্যসাধনের মধ্যে সীমার বন্ধনকে বিদীর্ণ করিয়া ভূমীকে প্রত্যক্ষ করাইয়া দিয়াছে। মানুষের মধ্যে ইহাই আনন্দরূপমমৃতম | কে যেন বিশ্বমহােৎসবে এই নীলাকাশের মহাপ্রাঙ্গণে অপূর্ণতার পাত পাড়িয়া গিয়াছেন— সেইখানে আমরা পূর্ণতার ভোজে বসিয়া গিয়াছি। সেই পূর্ণতা কত বিচিত্র রূপে এবং কত বিচিত্র স্বাদে ক্ষণে ক্ষণে আমাদিগকে অভাবনীয় ও অনির্বচনীয় চেতনার বিস্ময়ে জাগ্ৰত করিয়া তুলিতেছে। এমন নহিলে রসস্বরূপ রস দিবেন কেমন করিয়া । এই রস অপূর্ণতার সুকঠিন দুঃখকে কানায় কানায় ভরিয়া তুলিয়া উছলিয়া পড়িয়া যাইতেছে। এই দুঃখের সোনার পত্রটি কঠিন বলিয়াই কি ইহাকে ভাঙিয়া চুরমার করিয়া এতবড়ো রসের ভোজকে ব্যর্থ করিবার চেষ্টা করিতে হইবে ; না, পরিবেশনের লক্ষ্মীকে ডাকিয়া বলিব হােক হােক কঠিন হােক কিন্তু ইহাকে ভরপুর করিয়া দাও, আনন্দ ইহাকে ছাপাইয়া উঠক ? জগতের এই অপূর্ণতা যেমন পূর্ণতার বিপরীত নহে, কিন্তু তাহা যেমন পূর্ণতারই একটি প্রকাশ তেমনি এই অপূর্ণতার নিত্যসহচর দুঃখও আনন্দের বিপরীত নহে, তাহা আনন্দেরই অঙ্গ। অর্থাৎ দুঃখের পরিপূর্ণতা ও সার্থকতা দুঃখই নহে তাহা আনন্দ । দুঃখও আনন্দরূপমমৃতম | এ কথা কেমন করিয়া বলি ? ইহাকে সম্পূর্ণ প্রমাণ করিবাই বা কী করিয়া ? কিন্তু অমাবস্যার অন্ধকারে অনন্ত জ্যোতিষ্কলোককে যেমন প্রকাশ করিয়া দেয়, তেমনি দুঃখের নিবিড়তম তমসার মধ্যে অবতীর্ণ হইয়া আত্মা কি কোনোদিনই আনন্দলোকের ধ্রুবদীপ্তি দেখিতে পায় নাই— হঠাৎ কি কখনোই বলিয়া উঠে নাই— বুঝিয়াছি, দুঃখের রহস্য বুঝিয়াছি, আর কখনো সংশয় করিব না ? পরম দুঃখের শেষ প্রান্ত যেখানে গিয়া মিলিয়া গেছে সেখানে কি আমাদের হৃদয় কোনো শুভমুহুর্তে চাহিয়া দেখে নাই ? অমৃত ও মৃত্যু, আনন্দ ও দুঃখ সেখানে কি এক হইয়া যায় নাই, সেইদিকেই কি তাকাইয়া ঋষি বলেন নাই যস্যচ্ছায়ামৃতং যস্য মৃত্যুঃ কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম | অমৃত যাহার ছায়া এবং মৃত্যুও যাহার ছায়া তিনি ছাড়া আর কোন দেবতাকে পূজা করিব | ইহা কি তর্কের বিষয় ? ইহা কি আমাদের উপলব্ধির বিষয় নহে? সমস্ত মানুষের অন্তরের মধ্যে এই উপলব্ধি গভীরভাবে আছে বলিয়াই মানুষ দুঃখকেই পূজা করিয়া আসিয়াছে, আরামকে নহে। জগতের ইতিহাসে মানুষের পরমপূজাগণ দুঃখেরই অবতার, আরামে ললিত লক্ষ্মীর ক্রীতদাস নহে। অতএব দুঃখকে আমরা দুর্বলতাবশত খর্ব করিব না, অস্বীকার করিব না, দুঃখের দ্বারাই আনন্দকে আমরা বড়ো করিয়া এবং মঙ্গলকে আমরা সত্য করিয়া জানিব । এ কথা আমাদিগকে মনে রাখিতে হইবে অপূর্ণতার গীেরবই দুঃখ, দঃখই এই অপূর্ণতার সম্পং,