পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8& と রবীন্দ্র-রচনাবলী নিজেকে ভুলাইব না- তুমি যে মানুষকে যুগে যুগে অসত্য হইতে সত্যে অন্ধকার হইতে জোতিতে মৃত্যু হইতে অমৃতে উদ্ধার করিতেছ, সেই যে উদ্ধারের পথ সে তো আরামের পথ নহে সে যে পরম দুঃখেরই পথ । মানুষের অন্তরাত্মা প্রার্থনা করিতেছে আবিরাবীর্ম এধি । হে আবিঃ, তুমি আমার নিকট আবির্ভূত হও । হে প্ৰকাশ, তুমি আমার কাছে প্রকাশিত হও— এ প্রকাশ তো সহজ নহে। এ যে প্ৰাণান্তিক প্রকাশ । অসত্য যে আপনাকে দগ্ধ করিয়া। তবেই সত্যে উজ্জ্বল হইয়া উঠে, অন্ধকার যে আপনাকে বিসর্জন করিয়া। তবেই জ্যোতিতে পরিপূর্ণ হইয়া উঠে এবং মৃত্যু যে আপনাকে বিদীর্ণ করিয়া। তবেই অমৃতে উদ্ভিন্ন হইয়া উঠে । হে আবিঃ, মানুষের জ্ঞানে মানুষের কর্মে মানুষের সমাজে তোমার আবির্ভাব এইরূপেই । এই কারণে ঋষি তোমাকে করুণাময় বলিয়া ব্যর্থ সম্বোধন করেন নাই | তোমাকে বলিয়াছেন রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম। হে রুদ্র, তোমার যে প্রসন্নমুখ তাহার দ্বারা আমাকে সর্বদা রক্ষা করো। হে রুদ্র, তোমার যে সেই রক্ষা, তাহা ভয় হইতে রক্ষা নহে, বিপদ হইতে রক্ষা নহে, মৃত্যু হইতে রক্ষা নহে- তাহা জড়তা হইতে রক্ষা, ব্যর্থত হইতে রক্ষা, তোমার অপ্রকাশ হইতে রক্ষা | হে রুদ্র, তোমার প্রসন্নমুখ। কখন দেখি, যখন আমরা ধনের বিলাসে লালিত, মানের মদে মত্ত, খাতির অহংকারে আত্মবিস্মৃতি, যখন আমরা নিরাপদ অকৰ্মণ্যতার মধ্যে সুখসুপ্ত তখন ? নহে, নহে, কদাচ নহে । যখন আমরা অজ্ঞানের বিরুদ্ধে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাড়াই, যখন আমরা ভয়ে ভাবনায় সত্যকে লেশমাত্র অস্বীকার না করি, যখন আমরা দুরূহ ও অপ্রিয় কর্মকেও গ্রহণ করিতে কুষ্ঠিত না হই, যখন আমরা কোনো সুবিধা কোনো শাসনকেই তোমার চেয়ে বড়ো বলিয়া মান্য না করি— তখনই বাঁধ বন্ধনে আঘাতে অপমানে দারিদ্র্যে দুর্যোগে, হে রুদ্র, তোমার প্রসন্ন মুখের জ্যোতি জীবনকে মহিমান্বিত করিয়া তুলে । তখন দুঃখ এবং মৃত্যু, বিঘ্ন এবং বিপদ প্রবল সংঘাতের দ্বারা তোমার প্রচণ্ড আনন্দভের ধ্বনিত করিয়া আমাদের সমস্ত চিত্তকে জাগরিত করিয়া দেয় ! নতুবা সুখে আমাদের সুখ নাই, ধনে আমাদের মঙ্গল নাই, আলসো আমাদের বিশ্রাম নাই । হে ভয়ংকর, হে প্ৰলয়ংকর, হে শংকর, হে ময়স্কর, হে পিতা, হে বন্ধু, অন্তঃকরণের সমস্ত জাগ্ৰত শক্তির দ্বারা উদ্যত চেষ্টার দ্বারা অপরাজিত চিত্তের দ্বারা তোমাকে ভয়ে দুঃখে মৃত্যুতে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করিব, কিছুতেই কুষ্ঠিত অভিভূত হইব না। এই ক্ষমতা আমাদের মধ্যে উত্তরোত্তর বিকাশ লাভ করিতে থাকুক এই আশীর্বাদ করে | জােগাও হে জাগাও- যে ব্যক্তি ও যে জাতি আপন শক্তি ও ধনসম্পদকেই জগতের সর্বাপেক্ষা শ্রেয় বলিয়া অঙ্ক হইয়া উঠিয়াছে তাহাকে প্রলয়ের মধ্যে যখন এক মুহূর্তে জগাইয়া তুলিবে তখন, হে রুদ্র, সেই উদ্ধত ঐশ্বর্যের বিদীর্ণ প্রাচীর ভেদ করিয়া তোমার যে জ্যোতি বিকীর্ণ হইবে তাহাকে আমরা যেন সৌভাগ্য বলিয়া জানিতে পারি- এবং যে ব্যক্তি ও যে জাতি আপন শক্তি ও সম্পদকে একেবারেই অবিশ্বাস করিয়া জড়তা, দৈন্য ও অপমানের মধ্যে নিজীব অসাড় হইয়া পড়িয়া আছে তাহাকে যখন দুৰ্ভিক্ষ ও মারী ও প্রবলের অবিচার আঘাতের পর আঘাতে অস্থিমজ্জায় কম্পান্বিত করিয়া তুলিবে তখন তোমার সেই দুঃসহ দুদিনকে আমরা যেন সমস্ত জীবন সমর্পণ করিয়া সম্মান করি।-- এবং তোমার সেই ভীষণ আবির্ভাবের সম্মুখে দাড়াইয়া যেন বলিতে পারি।-- আবিরাবীর্ম এধি- রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম। দারিদ্র্য ভিক্ষুক না করিয়া যেন আমাদিগকে দুৰ্গম পথের পথিক করে, এবং দুর্ভিক্ষ ও মারী আমাদিগকে মৃত্যুর মধ্যে নিমজ্জিত না করিয়া সচেষ্টতর জীবনের দিকে আকর্ষণ করে। দুঃখ আমাদের শক্তির কারণ হউক, শোক আমাদের মুক্তির কারণ হউক, এবং লোকভয় রাজভয় ও মৃত্যুভয় আমাদের জয়ের কারণ হউক। বিপদের কঠোর পরীক্ষায় আমাদের মনুষ্যত্বকে সম্পূর্ণ সপ্রমাণ করিলে তবেই, হে রুদ্র, তোমার দক্ষিণমুখ আমাদিগকে পরিত্রাণ করিবে ; নতুবা অশক্তের প্রতি অনুগ্রহ,