পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ধর্ম । 旁 SS C আলসের প্রতি প্রশ্রয়, ভীরুর প্রতি দয়া কদাচই তাহা করিবে না— কারণ সেই দয়াই দুৰ্গতি, সেই দয়াই অবমাননা ; এবং হে মহারাজ, সে দয়া তোমার দয়া নহে । >○>8 শান্তং শিবমদ্বৈতম অনন্ত বিশ্বের প্রচণ্ড শক্তিসংঘ দশ দিকে ছুটিয়াছে, যিনি শান্তং তিনি কেন্দ্ৰস্থলে ধ্রুব হইয়া অচ্ছেদ্য শান্তির বল্পা দিয়া সকলকেই বাধিয়া রাখিয়াছেন, কেহ কহাকেও অতিক্রম করিতে পারিতেছে না । মৃত্যু চতুর্দিকে সঞ্চরণ করিতেছে কিন্তু কিছুই ধ্বংস করিতেছে না, জগতের সমস্ত চেষ্টা স্ব স্ব স্থানে একমাত্র প্রবল কিন্তু তাঁহাদের সকলের মধ্যে আশ্চর্য সামঞ্জস্য ঘটিয়া অনন্ত আকাশে এক বিপুল সৌন্দর্যের বিকাশ হইতেছে। কতই ওঠাপড়া কতই ভাঙাচোরা চলিতেছে, কত হানাহানি কত বিপ্লব, তবু লক্ষ লক্ষ বৎসরের অবিশ্রাম আঘাতচিহ্ন বিশ্বের চিরনতুন মুখচ্ছবিতে লক্ষই করিতে পারি না। সংসারের অনন্ত চলাচল অনন্ত কোলাহলের মর্মস্থান হইতে নিত্যকাল এক মন্ত্র ধ্বনিত হইতেছে শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ । যিনি শান্তং তাঁহারই আনন্দমূর্তি চরাচরের মহাসনের উপরে ধ্রুবরূপে প্রতিষ্ঠিত । আমাদের অন্তরাত্মাতেও সেই শান্তং যে নিয়ত বিরাজ করিতেছেন, তাহার সাক্ষাৎলাভ হইবে কী উপায়ে ? সেই শান্তস্বরূপের উপাসনা করিতে হইবে কেমন করিয়া ? তাহার শান্তরীপ। আমাদের কাছে প্রকাশ হইবে কবে ? ? আমরা নিজেরা শান্ত হইলেই সেই শান্তস্বরূপের আবির্ভাব আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হইবে । নাই ? নিভৃত নদীতীরে প্রশান্ত সন্ধ্যায় আমরা দুজনমাত্র লোক যদি কলহ করি, তবে সায়াহ্নের যে অপরিমেয় স্নিগ্ধ নিঃশব্দতা আমাদের পদতলের তৃণাগ্র হইতে আরম্ভ করিয়া সুদূরতম নক্ষত্ৰলোক পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত হইয়া আছে, দুটিমাত্র অতিক্ষুদ্র ব্যক্তির অতিক্ষুদ্র কণ্ঠের কলকলায় তাহা আমরা অনুভবও করিতে পারি না । আমার মনের এতটুকু ভয়ে জগৎ চরাচর বিভীষিকাময় হইয়া উঠে, আমার মনের এতটুকু লোভে আমার নিকটে সমস্ত বৃহৎ সংসারের মুখশ্ৰীতে যেন বিকার ঘটে । তাই বলিতেছি, যিনি শাস্তং, তাহাকে সত্যভাবে অনুভব করিব কী করিয়া, যদি আমি শান্ত না হই ? আমাদের অন্তঃকরণের চাঞ্চল্য কেবল নিজের তরঙ্গগুলাকেই বড়ো করিয়া দেখায়, তাহারই কল্লোল বিশ্বের অন্তরতম বাণীকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে । নানা দিকে আমাদের নানা প্রবৃত্তি যে উদাম হইয়া ছুটিয়াছে, আমাদের মনকে তাহারা একবার এ-পথে একবার ও-পথে ছিড়িয়া লইয়া চলিয়াছে, ইহাদের সকলকে দৃঢ় রশ্মিদ্বারা সংযত করিয়া সকলকে পরস্পরের সহিত সামঞ্জস্যের নিয়মে আবদ্ধ করিয়া অন্তঃকরণের মধ্যে কর্তৃত্বলাভ করিলে, চঞ্চল পরিধির মাঝখানে আচঞ্চল কেন্দ্রকে স্থাপিত করিয়া নিজেকে স্থির করিতে পারিলে তবেই এই বিশ্বচরাচরের মধ্যে যিনি শান্তং, তাহার উপাসনা তাহার উপলব্ধি সম্ভব হইতে পারে। জীবনের হ্রাসকে, শক্তির অভাবকে আমরা শান্তি বলিয়া কল্পনা করি। জীবনহীন শান্তি তো মৃত্যু, শক্তিহীন শান্তি তো লুপ্তি। সমস্ত জীবনের সমস্ত শক্তির অচলপ্রতিষ্ঠ আধারস্বরূপ যাহা বিরাজ করিতেছে, তাহাই শান্তি ; অদৃশ্য থাকিয়া সমস্ত সুরকে যিনি সংগীত, সমস্ত ঘটনাকে যিনি ইতিহাস করিয়া তুলিতেছেন, একের সহিত অন্যের যিনি সেতু, সমস্ত দিনরাত্ৰি-মাসপক্ষ-ঋতুসংবৎসর চলিতে চলিতেও যাহার দ্বারা বিধূত হইয়া আছে, তিনিই শান্তম। নিজের সমস্ত শক্তিকে যে সাধক বিক্ষিপ্ত না কীরিয়া ধারণ করিতে পারিয়াছেন, তাহার নিকটে এই পরম শান্তস্বরূপ প্ৰত্যক্ষ । বাষ্পই যে রেলগাড়ি চালায়, তাহা নহে, বাষ্পকে যে স্থিরবুদ্ধি লীেহশৃঙ্খলে বদ্ধ করিয়াছে, সে-ই গাড়ি চালায়। গাড়ির কলটা চলিতেছে, গাড়ির চাকাগুলা ছুটিতেছে, তবুও গাড়ির মধ্যে গাড়ির এই